পাবনায় ঐতিহাসিক
ভুট্টা আন্দোলন

।। আমিরুল ইসলাম রাঙা।।
১৯৬৭ সালের ১৬ মার্চ পাবনায় সংঘটিত হয়েছিল ভুট্টা আন্দোলন। রেশন থেকে দেওয়া ভুট্টার আটার রুটি খেয়ে বহু মানুষ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় । উক্ত ঘটনায় দুইজনের মৃত্যু এবং অসংখ্য মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এই ঘটনার পর পাবনার সর্বস্তরের জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে মুসলিম লীগ নেতা ও সরকার দলীয় এমএনএ এবং পার্লামেন্টারি সেক্রেটারী ( ফুড) ক্যাপ্টেন আসগর হোসেন জায়েদীর বাড়ীতে আক্রমন এবং অগ্নিসংযোগ করে। বিক্ষুদ্ধ জনতাকে নিবৃত্ত করতে যেয়ে ক্যাপ্টেন জায়েদী গুলিবর্ষণ করলে একজন নিহত এবং প্রায় ১২ জন গুলিবিদ্ধ হন। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা শহরের দু’টি বন্দুকের দোকান ভেঙ্গে বন্দুক লুট করে ক্যাপ্টেন জায়েদীর রুপকথা রোডের বাড়িতে বন্দুক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা দাঙ্গা পুলিশের সহযোগীতায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য ক্যাপ্টেন জায়েদীকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায় । এই সময় দুইজন পুলিশ সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হয়। এরপর পাবনার জেলা প্রশাসন কার্ফু জারী করে শত শত নেতাকর্মী এবং সাধারন জনগনকে গ্রেপ্তার করেছিল। এই ঘটনাটি তখন গোটা পাকিস্তান জুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের দশ বছর শাসন কালে এটি ছিল অন্যতম বৃহৎ আন্দোলন এবং সশস্ত্র বন্দুক যুদ্ধ। তৎকালীন সময়ে গোটা দেশজুড়ে এই আন্দোলনটি ভুট্টা আন্দোলন নামে খ্যাত হয়েছিল।

১৯৬৭ সালের ভুট্টা আন্দোলনের সময় আমার বয়স ১৪ বছর। আমি তখন রাধানগর মজুমদার একাডেমীতে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। প্রায় একবছর আগেই আমি রাজনীতির স্বঘোষিত কর্মী। ১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাবনা আগমন এবং টাউন হল ময়দানে সভার আমি শ্রোতা এবং খুদে কর্মী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। পাবনায় বঙ্গবন্ধু সভা করার ৩/৪ দিন পরে উনি গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তারের পর তাঁর মুক্তির দাবীতে পাবনায় যে মিটিং মিছিল হয়েছে তার অনেক মিছিলে আমি শরীক হয়েছি। পাবনায় ১৯৬৭ সালে একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস পালিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালের পর সেবার পাবনায় ব্যাপক এবং জাঁকজমক ভাবে শহীদ দিবস পালিত হয়েছিল। আগের সারারাত জেগে আমার পাড়ার বড় ভাইদের সাথে প্রভাতফেরীর মিছিল নিয়ে গোটা শহর ঘুরে এডওয়ার্ড কলেজের ব্যায়ামাগারের পাশে টেনিস গ্রাউন্ডে অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছিলাম।। তখন ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে অনেকটা সক্রিয় হয়েছি। একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের ঠিক পঁচিশ দিন পরে ১৬ মার্চ সংঘটিত হয় ভুট্টা আন্দোলন।

ভুট্টা আন্দোলনের দিন যথারীতি স্কুলে যাই। স্কুলের সাথেই এডওয়ার্ড কলেজ অবস্থিত। স্কুলে পৌঁছানোর আগেই বুঝতে পারলাম আজ কিছু একটা হয়েছে। কলেজ আর স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা তখন কলেজ মাঠ জুড়ে দাড়িয়ে আছে। ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে তাদের কর্মীদের জড়ো করতে থাকে। এরপর সবাইকে মিছিল করে শহরে যেতে হবে। তখন জানলাম রাতে বিষাক্ত ভূট্টার আটার রুটি খেয়ে বহু মানুষ মারা গেছে। হাসপাতালে হাজার হাজার লোক অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালে রোগী রাখার জায়গা নাই। বর্তমান ডায়াবেটিস হাসপাতাল হলো তখনকার পাবনা সদর হাসপাতাল। আমরা স্কুলের শ্রেনী কক্ষে বইপত্র রেখে যার যার দলের মিছিলে শরীক হলাম। আমি ছাত্রলীগের মিছিলের সাথে যখন শহরে এলাম তখন চারিদিক থেকে হাজার হাজার ছাত্র, যুবক, শ্রমিক এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মী জড়ো হয়েছে। গোটা শহর জুড়ে লোকে লোকারণ্য। হাসপাতালের চারপাশে হাজার হাজার মানুষ। রাস্তায় দাঁড়ানোর জায়গা নাই। কি হয়েছে – কত লোক মারা গেছে সেটা জানার উপায় নাই। সময় যত বাড়ছে – মানুষও তত বাড়ছে। একদল মিছিল নিয়ে আসছে আবার আরেকদল চলে যাচ্ছে।

সেই আন্দোলনে বেশীর ভাগ অংশ গ্রহনকারী ছিলেন স্কুল কলেজের ছাত্র। এছাড়া হোসিয়ারী শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক এবং সর্বস্তরের জনগণ। সেদিন আমি পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, বর্তমান ডায়াবেটিস হাসপাতাল এবং টাউন হল এলাকার সামনে ছিলাম। টাউন হলের বারান্দা থেকে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বক্তৃতা দিচ্ছেন। সেদিন আমিনুল ইসলাম বাদশা সহ অনেক নেতাকে প্রথম দেখেছিলাম এবং তাঁদের ভাষন শুনেছিলাম। ঠিক এমন একটি সময় হট্টগোল আর দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। পরে শুনেছিলাম পাবনার মুসলিম লীগের প্রধান নেতা, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য ও সংসদীয় খাদ্য কমিটির সেক্রেটারী সৈয়দ আজগর হোসেন জায়েদী হাসপাতালে নিহত এবং আহতদের দেখতে আসলে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা তাঁকে লাঞ্চিত করে। আন্দোলনকারীরা তাঁকে টাউন হলে গিয়ে মাইকে দোষ স্বীকার করাতে চাইলে সে রাজী হয় নি। এতে বিক্ষোভকারী তাঁকে লাঞ্চিত করে। সে একপর্যায়ে দৌড়ে রূপকথা সিনেমা হল রোডে তাঁর বাড়ীতে ( বর্তমান শহীদ আমিন উদ্দিন আইন কলেজ) গিয়ে উঠে।

এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা ক্যাপ্টেন জায়েদীর বাড়ীর চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। আমি ছিলাম তাঁর বাড়ীর দক্ষিন দিকে। যেটাকে বলা হতো ফকিরনী পাড়া ( বর্তমান শান্তিনগর)। জায়েদীর বাড়ীর দক্ষিন পশ্চিমে সাথের বাড়ীটি ছিল আমাদের আটঘরিয়ার রাধাকান্তপুর গ্রামের বন্ধু শাজাহান ও ছানাদের বাড়ী। সাথের বাড়ীটি হলো স্কুলের সহপাঠী বন্ধু শফিকুল ইসলাম মানিকদের বাড়ী। আমি নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করে পিছনের অংশের সব কিছু দেখছিলাম । তখন বিক্ষুব্ধ জনতা জায়েদীর বাড়ীর পিছন গেট ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল। কেউ কেউ বাড়ীর পিছনে প্রাচীরের উপর উঠার চেষ্টা করছিল। আমার চোখে এখনো সেই ছবি জীবন্ত হয়ে আছে। আমি দেখছি আমাদের পাড়ার মুকুল ভাই সহ অনেকে প্রাচীরের উপর উঠেছে। ঠিক তখনি জায়েদীর বাড়ী থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়।

সেদিন জায়েদীর বাড়ি থেকে ছোঁড়া গুলিতে শেফালী রানী নামে ৭/৮ বছরের এক মেয়ে নিহত হয় । প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা আহমেদ রফিক, শ্রমিকনেতা রাজেন আলী, ইমাম আলী, নয় বছর বয়সের বালক সেফার সহ ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়। পরে রাজেনের গুলিবিদ্ধ পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। ( সেদিনের গুলিবিদ্ধ রাজেন আলী স্বাধীনতার পর নুতন গলির মাথায় চায়ের দোকান দিয়েছিল)। ক্যাপ্টেন জায়েদীর বাড়ী থেকে গুলিবর্ষণে নিহত এবং আহত হওয়ার পর আন্দোলনকারী জনতা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে । তারা জায়েদীর বাড়ীতে অবস্থিত পিআইএ ( পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স ) অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ জনতা পাবনার প্রধান সড়ক আব্দুল হামিদ রোডের দুটি বন্দুকের দোকান লুট করে। সেই বন্দুক দিয়ে জায়েদীর বাড়ী আক্রমন করে। এক পর্যায়ে পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ খোরশেদ আলমের ( পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়েছিলেন) নেতৃত্বে দাঙ্গা পুলিশের একটি দল ক্যাপ্টেন জায়েদীর বাড়ীতে এসে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার পথে পাবনা প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতার গুলিতে পুলিশের সিপাহী সোলায়মান আলী এবং জেলা প্রশাসকের আরদালী নুরুল ইসলাম আহত হয়। সেদিন সারা পাবনা শহর রনক্ষেত্রে পরিনত হয়েছিল।

এমন ভীতিকর অবস্থায় আমি দ্রুত বাড়ীতে চলে আসি। সেদিন আর কি ঘটেছিল তখন সেটা জানা সম্ভব হয়নি। পরে বিভিন্ন তথ্যসুত্রে জানতে পারি বিষাক্ত ভুট্টার আটার রুটি খেয়ে দুইজন মারা গিয়েছিল। তাঁরা হলেন শহরের রামচন্দ্রপুর গ্রামের আব্দুল গফুর এবং তাঁর স্ত্রী। মোট ১৭ জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন।

এই ঘটনার পর পুলিশ প্রায় দুই শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করেছিল। এদের মধ্যে দুটি মামলায় ৬৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। উক্ত ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন, ক্যাপ্টেন এম, মনসুর আলী, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেন, ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা, অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন, অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন, অ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, খন্দকার আবু তালেব, মাওলানা আব্দুস সোবহান, সাংবাদিক আনোয়ারুল হক, নাজমুল হক নান্নু, টিপু বিশ্বাস , মতিউর রহমান বাচ্চু, শালগাড়ীয়ার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসনাত, মোঃ ইয়াকুব আলী, জামাত আলী জম্মু, মেহের আলী, ময়েন উদ্দিন সেখ, কেরামত আলী, শেখ খবির উদ্দিন, মোঃ নাসিম, ফজলুর রহমান পটল, আহমেদ রফিক, সাঈদ তালুকদার, হোসেন আলী খাঁ , আবুল হোসেন নায়েব মিয়া, গদা বাবু, পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন আহমেদ, শরীফ উদ্দিন ভোলা মিয়া, সাংবাদিক হাসনাতুজ্জামান হীরা, হাজারী গোলাম ফারুক ঝন্টু, মোক্তার হোসেন, গোলাম মোস্তফা আলো, সুভাষ চন্দ্র সরকার প্রমুখ। উক্ত মামলার বিচারে আদালত গোলাম মোস্তফা আলো, হাজারী গোলাম ফারুক ঝন্টু ও সুভাষ চন্দ্র সরকার কে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা করেছিল।

কালের পরিক্রমায় ঐতিহাসিক ভুট্টা আন্দোলনের কথা আজ অনেকেই ভুলে গেছেন। পাবনার রাজনীতির ইতিহাসে এমন ঘটনাটি আজ বিস্মৃতিপ্রায়। আজকের প্রজন্ম হয়তো কিছুই জানেনা। উক্ত আন্দোলনে জীবন বিসর্জনকারীদের নাম হয়তো কারো স্মরণে নাই। আমরা ভুলে গেছি সেই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ আহতদের কথা। ভুলে গেছি শত শত মানুষের জেল জুলুম ও নির্যাতনের কথা। পরিশেষে পাবনার জনপ্রতিনিধি , জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে আবেদন ঐতিহাসিক ভুট্টা আন্দোলনে নিহত শহীদের স্মরণে এবং তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে ঘটনাস্থল রূপকথা রোডে অবস্থিত শহীদ আমিন উদ্দিন আইন কলেজ প্রাঙ্গনে ( তৎকালীন ক্যাপ্টেন জায়েদীর বাড়ি) একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হোক। এছাড়া প্রতিবছর ১৬ মার্চ ঐতিহাসিক ভুট্টা আন্দোলন দিবস পালন করা হোক। ( সমাপ্ত)

লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।