রংপুরের ভিন্ন জগতে কিছুক্ষণ

এবাদত আলী

স্বপ্নপুরীতে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে তড়ি ঘড়ি করে আবার আমরা মাইক্রোবাসে গিয়ে উঠলাম। এবার আমাদের গন্তব্যস্থল রংপুরের ভিন্ন জগত।
পাবনার আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের বার্ষিক বনভোজনে অংশ নিতে প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠিতা সভাপতি হিসাবে আমি, প্রেসক্লাবের সভাপতি এইচ কে এম আবুবকর সিদ্দিক, প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবদুস সাত্তার মিয়া, সাবেক সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াছিন ও খাইরুল ইসলাম বাসিদ, সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম, সৈয়দ সাইফুল ইসলাম, আখতারুজ্জামন আক্কাছ, জিল্লুর রহমান, বুরহানুল ইসলাম এবং আমার ছোট ছেলে তানভীর মাহমুদ সৈকতসহ আরো কয়েক জন ভোর বেলা বেরিয়ে স্বপ্নপুরী ভ্রমণ শেষে ভিন্ন জগতের পথে।
শেষ ফাগুনের বসন্ত দুপুরে তাই আমাদের যাত্রা পথে তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। রংপুরের পাগলাপীর হতে সামান্য কিছুদুর যাবার পরই পাওয়া গেল আমাদের বহু কাংখিত ভিন্ন জগত। নিয়ম মাফিক টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করতেই ভিন্ন জগতের আমেজ। বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ভিন্ন জগত। গঙ্গাচড়া উপজেলার গঞ্জীপুরে প্রায় এক হাজার বিঘা জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ভিন্ন জগত। সৌদি প্রবাসী শাহ আলম চৌধুরী নামক জনৈক ব্যক্তি শখের বশবর্তী হয়ে সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে গড়ে তুলেছেন বৃহত্তম এই বিনোদন কেন্দ্র ভিন্ন। যার যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সাল হতে।
ভিন্ন জগতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রথমেই যে বিষয়টি সকল দর্শনার্থীকে আকৃষ্ট করে তা হলো প্লানেটরিয়াম। অর্থাৎ বিশ্ব ভূমন্ডলের চন্দ্র, সুর্য, গ্রহ-নক্ষত্র এক কথায় সৌর জগতের সকল গ্রহ সম্পর্কিত ধারণা জোগাতেই এই প্লানেটরিয়ামের সুব্যবস্থা করা। বিশাল আয়তনের একটি সুউচ্চ অডিটরিয়ামের অভ্যান্তরে বসানো হয়েছে সৌর জগতের মেলা।
জন প্রতি ৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে প্লানেটরিয়ামে প্রবেশ করা হলো।
গোলাকার বৃত্তের এই অডিটরিয়ামে দর্শক আসন সংখ্যা রয়েছে ২শ ৫০ টি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতি আধা ঘন্টা পর পর শো চলে। শো শুরু হলে এই অডিটরিয়ামটি যেন অন্ধকার গুহায় পরিণত হয়। দর্শকবৃন্দ একে অপরের পাশে গায়ে গা লাগিয়ে বসে। এখানে নারী- পুরুষ ,যুব, বৃদ্ধ, বৃদ্ধার কোন বাচ বিচার নেই। যে যেখানে পারে নিজ নিজ আসনে বসে পড়ে। আগে আসলে আগে পাবেন এই নিয়মের ভিত্তিতে এখানকার আসন গুলো বরাদ্দ করা হয়। তাই সকল দর্শকই যেন একে অপরের পরম আত্মীয়। শো শুরুর আগে মূহুর্তের মধ্যে হল রুমটি ঘুট ঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। তখন একে অপরকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এখানে যেন সকলেই একই পরিবারের সদস্য।
মাইক্রোফোনে দারাজ কন্ঠের শব্দ চয়নের পাশা পাশি মাথার উপরে বিশালকায় পর্দায় সার্চ লাইটের আলো ফেলে রাতের আঁধারে জ্বল জ্বলে তারা ও গ্রহ নক্ষত্র পুঞ্জের আবির্ভাব ঘটে। দৃশ্যমান হয় ছায়া পথের। বিশাল অগি œগহ্বরের সুর্যের চার পাশে পৃথিবী নামক গ্রহটি অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। আপন কক্ষ পথে ঘুরছে চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহ। নক্ষত্র পুঞ্জ জ্বলছে জ্বল জ্বল করে। তারকা পুঞ্জ মিট মিট করে জ্বলছে গোটা পৃথিবীর আকাশ জুড়ে। রয়েছে বিস্তীর্ন এলাক জুড়ে ছায়াপথ,-আছে নিহারিকা। এখানে দেখানো হলো উল্কাপিন্ডের পতনের দুর্লভ দৃশ্য। নভোযান খেয়া তরী থেকে নীল আর্ম ষ্ট্রং এর চন্দ্রে অবতরনের দৃশ্যও দেখানো হলো সার্চ লাইটের আলো ফেলে। একনিবিষ্টে এ সকল দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় শেষের ঘন্টা বেজে উঠলো। সৌর জগত থেকে বের হয়ে আবার আমরা ভিন্ন জগতের মাঠে পা রাখলাম।
শুরু হলো পায়ে হাঁটা। ভিন্ন জগতের তিন দিকে বিশাল লেক। খরা মৌসুম সমাগত বলে লেকে পানির পরিমান কম থাকলেও সৌন্দর্যের কোন ঘাটতি নেই। লেকের উপরে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি ব্রিজ রয়েছে। ব্রিজ গুলোতে রয়েছে সুন্দর রেলিং যা শোভা বর্দ্ধনে সহায়তা করেছে। একটি ব্রিজের ওপারে রয়েছে একটি মঞ্চ। যার নাম খোলা মঞ্চ। মঞ্চের গায়ে শিল্পীর তুলির আঁচড়ে নিপুন হাতে উদীয়মান সুর্যের আলোক রশ্মি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই খোলা মঞ্চে বড় সড় আকারের অনুঠান করার সুব্যবস্থা রয়েছে। মঞ্চের সামনে প্রশস্ত চত্বরে সবুজ ঘাসের উপর কিংবা আশে পাশের লতা গুল্মের আড়ালে বসে প্রেমিক-প্রেমিকেরা তাদের মনের কথা কয় নির্দ্ধিায়। শুধু এখানেই নয়, এমনি ধরনের অনেক নিরিবিলি স্থান রয়েছে এই ভিন্ন জগতের অভ্যন্তরে। এখানে বনভোজন ও আনন্দ ভ্রমণে প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসে। তাই সকল বয়সের মানুষের জন্যই এখানে চিত্তাকর্ষনের ব্যবস্থা রয়েছে।
পশ্চিম দিকের একটি লেকের ওপারে যেতে টিকিট কিনতে হয়। সেতু পেরিয়ে খানিক দুর যেতেই একটি পুরু মানুষের প্রতিকৃতি। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে একজন মানুষ। তার বুকের উপর দিয়ে প্রশস্থ রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে ঐ মানুষের মুখ গহ্বরের ভিতরে প্রবেশ করে সুড়–ঙ্গ পথ বেয়ে অনেক দুর গিয়ে আবার উপরে উঠতে হয়। সুড়ঙ্গ পথে ভ্রমণের আনন্দই আলাদা। ভিন্ন জগতে মুল ভু-খন্ডে রয়েছে বিভিন্ন জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি। এখানে আছে হস্তি ঝরনা। একটি প্রকান্ড হাতি শুঁড় উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঐ হাতির শুঁড় বেয়ে ঝরনা ধারায় অবিরত পানি ঝরছে। ভিন্ন জগতে রয়েছে পরীর আবক্ষ মুর্তি। এই পরী মুর্তিকে ঘিরে যুবক- যুবতিদের ছবি ওঠার ধুম পড়ে যায়। ভিন্ন জগতের অভ্যন্তরে বাঘ, হরিন সহ বিভিন্ন প্রানীর প্রতিকৃতি রয়েছে। এখানে একটি বৃহৎ বেদীতে রয়েছে ফনা তোলা তিনটি সাপের প্রতিকৃতি। পাশেই রয়েছে সাপুড়ের বাঁশি।এটির ভাষ্কর মাহাতাব। এখানে সব সময়ই ছবি উঠার জন্য ভিড় লেগে থাকে। একটু দুরেই রয়েছে একটি ময়ুরের প্রতিকৃতি, এখানেও ছবিতে পোঁজ দেয় অনেকেই। এটিরও ভাষ্কর মাহাতাব। শিল্পকর্মের তারিখ ২২-১২-২০০৭, যা পাথরে খোদাই করা রয়েছে।
এখান থেকে বেশ খানিকটা দুরে একটি বেদীতে রয়েছে একটি বিশাল আকৃতির ডাইনোসর এবং অপরটি অপেক্ষাকৃত ছোট ডাইনোসর। ডাইনোসরের পায়ের কাছে রয়েছে একটি
প্রকান্ড ডিম। পাশে আরেকটি ডিম ভাঙা অবস্থায় রয়েছে।
পাশেই রয়েছে বরফের দেশ। পাঁচ টাকার টিকিটের বিনিময়ে বরফের দেশে অনায়াসেই ঘুরে আসা যায়।ভিন্ন জগতের গোটা এলাকা ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ভিন্ন জগতের অভ্যন্তরে রাইয়ানুল ইসলামের দোকানে চা পর্ব সমাধা করে আমরা মাইক্রোবাসে গিয়ে বসলাম। আমাদের মাইক্রোবাস পাকা সড়কে উঠে পড়লো। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)