// সঞ্জু রায়, বগুড়াঃ দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বগুড়ার শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামে অধীর আগ্রহে বগুড়াবাসী অপেক্ষায় ছিলো একটি আন্তর্জাতিক খেলা দেখার। কিন্তু সেগুড়ে বালি দিয়ে একদিনের মাঝেই যেন বদলে গেলো উত্তরের ক্রীড়াঙ্গণের সম্ভাবনাময় এই স্টেডিয়ামটির ভবিষ্যৎ। জেলা ক্রীড়া সংস্থার বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে কোন আলোচনা কিংবা নোটিশ ছাড়াই গত ২মার্চ বগুড়ার শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়াম থেকে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। শুধু তাই নয় স্টেডিয়াম থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গ্রাউন্ডসের সকল সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র। এই ঘটনায় বিসিবির এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত দ্রুততম সময়ে পরিবর্তন করে এই স্টেডিয়ামে আবারো আন্তর্জাতিক খেলা চালুর দাবিতে বগুড়ায় এখন বইছে প্রতিবাদের ঝড়।
বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গণের মানুষের আবেগের একটি স্থান শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়াম থেকে বৃহস্পতিবার যখন স্টেডিয়ামের মালামাল কার্গো তে তোলা হচ্ছিল তখন থেকেই সোশ্যাল মিডিয়াসহ শহরজুড়ে শুরু হয়ে যায় প্রতিবাদের ঝড়। যার ধারাবাহিকতায় বগুড়ায় এই দুইদিনে ৩টি প্রতিবাদী মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার স্টেডিয়ামের বাহিরে বিসিবির এই সিদ্ধান্ত বাতিলে দাবিতে এআরসি স্পোটিং ক্লাব ও বগুড়ার সাধারণ জনগণের আয়োজনে প্রথম প্রতিবাদী মানব-বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে শনিবার সকালে চাঁন্দু স্টেডিয়ামে প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগের খেলা চলাকালীন সময়ে বগুড়ার প্রতি বিসিবির বিমাতাসুলভ আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে মানব-বন্ধন করেন খেলোয়াড় ও আম্পায়াড়রা। এছাড়াও একই দিন বিকেল সাড়ে ৩ টায় শহরের সাতমাথায় বগুড়াবাসীর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই ঘটনার প্রতিবাদে সবচেয়ে বড় মানব-বন্ধন যেখানে সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়বৃন্দ, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মী, ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ প্রায় ৩ শতাধিক বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
ক্রীড়া সংগঠক মুকুল ইসলামের সঞ্চালনায় বগুড়াবাসীর ব্যানারে এ মানববন্ধনে পর্যায়ক্রমে বক্তব্য রাখেন বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান রনি, বগুড়া প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম বাবু, ব্যবসায়ী নেতা পরিমল প্রসাদ রাজ, ক্রীড়া সংগঠক মাহবুব আলম জিয়ন, যুবলীগ নেতা মোশারফ হোসেন বুলবুল, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মাহিদুল ইসলাম খান জয়, জেলা ক্রিকেটার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসানসহ অনেকে।
যেখানে বক্তারা বলেন, শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়াম থেকে বিসিবির কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়া হটকারী এক সিদ্ধান্ত। বিসিবির হাস্যকর এই সিদ্ধান্ত বগুড়াবাসীর জন্য লজ্জার। বগুড়া থেকে মুশফিকুর রহিম, শফিউল সুহাস, তৌহিদ হৃদয়, তামিমের মতো খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয় এই মাঠে নিয়মিত এখনো ৫ শতাধিক এর বেশি খেলোয়াড় অনুশীলন করে যাচ্ছে। এই স্টেডিয়ামের প্রতি শুরু থেকে বিসিবি বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে। যেখানে বগুড়ার স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক যেকোন ভেন্যুর মতোই মানসম্মত। সেখানে এই মাঠকে পরিচর্যা না করে উল্টো নতুন নতুন মাঠ তৈরি করে কোটি টাকা নষ্টের পাঁয়তারা করছে একটি গোষ্ঠী। যদি অবিলম্বে বগুড়ার চান্দু স্টেডিয়ামে বিসিবি তাদের কার্যক্রমসহ আন্তর্জাতিক ভেন্যু চালু না করে তাহলে লংমার্চ করা হবে। দ্রুত এই ভেন্যুতে আন্তর্জাতিক খেলা বিসিবি কে ফিরিয়ে দিতে হবে বলে দাবি জানান তারা।’
জানা যায়, ২০০৩-০৪ অর্থ বছরে ২১ কোটি টাকায় বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে একটি আন্তর্জাতিক ভেন্যুতে (ফ্লাড-লাইটসহ) উন্নীত করা হয়। স্টেডিয়ামে চার টাওয়ারে ১০০টি করে মোট ৪০০ ফ্লাড-লাইট রয়েছে। এই লাইটগুলো ৮ লাখ ওয়াট বিদ্যুতের আলো সরবরাহ করতে পারে। আন্তর্জাতিক খেলা বন্ধের পরে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে একবার ফ্লাডলাইটগুলো জ্বালানো হয়েছিল। এই মাঠে আগে থেকেই ভালো মানের পাঁচটি উইকেট (পিচ) রয়েছে। ২০০৬ সালের ৩০ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে ঘোষণা করে। একই বছরে স্টেডিয়ামটি আন্তর্জাতিক টেস্ট ভেন্যুর স্বীকৃতিও পেয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে ২০০৬ সালের পর থেকে এ মাঠে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে কোনো খেলা উপভোগ করা দর্শকদের ভাগ্যে জোটেনি। তবে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় লিগ, স্থানীয় প্রিমিয়ার ডিভিশন, প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ ও করপোরেট লীগ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল এই মাঠে।
এই অবস্থার মাঝেই গত ২ মার্চ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব বরাবর বিসিবি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষরিত পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে বিগত কয়েক বছর যাবত জেলা ক্রীড়া সংস্থার অসহযোগিতার কারনে নিয়মিত টুর্ণামেন্ট আয়োজন করতে না পারায় স্টেডিয়াম সংরক্ষনের দায়িত্ব ক্রীড়া পরিষদের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিসিবি। শুধু তাই নয় বিসিবির বগুড়া ভেন্যু ম্যানেজারসহ মোট ১৭ জন কর্মকতা-কর্মচারীকে প্রত্যাহারপূর্বক স্টেডিয়ামে থাকা বিসিবির সকল মালামাল শনিবারের মধ্যেই বিসিবি প্রধান কার্যালয়ে যাওয়ার আদেশ হয়।
যদিও অসহযোগিতার এমন দোষারোপকে সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি করে বিসিবির স্বেচ্ছাচারিতা ও সুদীর্ঘ বছর যাবত এই স্টেডিয়ামকে ঘিরে তাদের উদাসীনতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মিলন। তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছরে এই মাঠে বিসিবি একটি আন্তর্জাতিক খেলা দিতে পারেনি। শুধু তাই নয় যে মাঠ ঘিরে উত্তরাঞ্চলের হাজারো ক্রীড়ামোদী মানুষের ভবিষ্যৎ জুড়ে আছে সেটি নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত সত্যিই কষ্টের ও লজ্জার। যদিও শনিবার সর্বশেষ মিলন তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানান, বিসিবির এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে অবশ্যই এই স্টেডিয়ামকে ঘিরে বগুড়ার ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলিত হবে বলেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
এদিকে শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছেন বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই বিসিবির এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আবেদন জানিয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও বিসিবি সভাপতি এই বিষয়ে আলোচনাও করেছেন। বগুড়াবাসীর জন্যে ইতিবাচক সংবাদও আসতে পারে মর্মে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি যার জন্যে সংশ্লিষ্টদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।