// মশাহিদ আহমদ, মৌলভীবাজার ঃ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহন প্রকল্প প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর অধীনে আবেদন ও নিষ্পত্তি ও ট্রান্সজেন্ডার চেইঞ্জ এজেন্টদের নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে শহরের রেষ্ট ইন হোটেলে আজ ২৮ জানুয়ারী। প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা চন্দন কুমার পাল এর সভাপতিত্বে ও মৌলভীবাজার জেলা জজ কোর্টের আইনজীবি মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান এর সঞ্চালনায় ১ম ও ২য় ধাপে বিশেষ অতিথি হিসাবে ছিলেন- মৌলভীবাজার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল নাসির, সিলেট জজ কোর্টের আইনজীবি সত্যজিৎ কুমার দাস, ব্লাস্ট প্রধান কার্যালয় এর অ্যাডভোকেসি অফিসার মোঃ শাহরিয়ার হোসেন। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- মৌলভীবাজার অগ্রগ্রামী মানব কল্যাণ সংস্থা সভাপতি আব্দুল মাহিদ চৌধুরী প্রমুখ। সভায় জানানো হয়- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ বা ইউএনসিআরপিডি এর আলোকে ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ প্রনয়ন করেছে। ইতিমধ্যে এই আইনের বিধিমালাও তৈরি করা হয়েছে। আইনটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের টেকসই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ন কৌশল হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১% সংখ্যালঘু, যাদের ধর্মীয়, জাতিগত ও লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় এবং ভৌগলিক অবস্থার কারনে মূলধারা থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছে। বিভিন্ন গবেষণা ও গণমাধ্যম প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ সকল জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, কর্মসংস্থান এবং আইনী সহায়তা লাভের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন। ক্রিশ্চিয়ান এইড এর কারিগরী সহযোগীতায় এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের আর্থিক সহযোগীতায় কনসোর্টিয়াম মেম্বার হিসেবে ব্লাস্ট, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েল সোসাইটি, নাগরিক উদ্যোগ এবং ওয়েভ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ৩ টি বিভাগের মোট ৮ টি জেলায় “এমপাওয়ারিং লেফট বিহাইন্ড মাইনোরিটি কমিউনিটি (ইএলএমসি)”নামক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ণ, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণকে সক্রিয়করণ এবং বিভিন্ন সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সকল প্রকার বৈষম্য দুর করার উদ্দেশ্যে কাজ করছে। উক্ত প্রকল্প কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ব্লাস্ট পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচারে অভিগম্যতা ও আইনগত সুরক্ষাবৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং আইনটি অধিকার কর্মী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেও কাছে সহজবোধ্য করার লক্ষে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর অধীনে আবেদন এবং নিষ্পত্তি বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক সভার আয়োজন করছে ।এই সভার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ঃ ক) সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক সভায় আগত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আইনী পরামর্শসহ আইনী সহায়তা প্রদান করা হলো এ সভার মূখ্য উদ্দেশ্য। এছাড়াও সর্বসাধারণকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ সম্পর্কে সচেতন করা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার বাস্তবায়নে তাদের করণীয় সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অংশগ্রহনমূলক আইনি পরামর্শ দেওয়া। খ) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহজ ভাবে তাদের আইনগত অধিকারগুলোর বিষয়ে জানানো যাতে করে তারা আইন সচেতন হয়ে নিজ নিজ অধিকার আদায়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উৎসাহিত হয়। গ) প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে সাধারণ জনগনকে সচেতন করা যাতে তারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সংবেদনশীল হয়। ঘ) ন্যায় বিচার সম্পর্কে সর্বসাধারনকে সচেতন করা। ঙ) ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে আগ্রহ সৃষ্টি করা। চ) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ কি ধরণের আইনগত সমস্যার সম্মুখীন হন তা জানা এবং আইনগত পরামর্শ প্রদান করা। ছ) ভুক্তভোগিদের নিকটে গিয়ে তাদের আইনগত সমস্যা সম্পর্কে জানা এবং তদানুযায়ী সমাধান দেওয়া। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র তার নাগরিকের প্রতি ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থান ভেদে কোনরূপ বৈষম্য প্রদর্শন করবেন না; ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী হবেন; ১৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে সচেষ্ট হবেন এবং ১৯ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যতা বিলোপ করিবার জন্য, সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এছাড়াও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষার জন্য ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। সংবিধানে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা রয়েছে পাশাপাশি বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষায় কিছু সুনির্দিষ্ট আইনও রয়েছে, তবুও প্রায়শই এই জনগোষ্ঠীসমূহ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইনগতভাবে বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বৈষম্যের মুলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিদ্যমান আইনসম্পর্কে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুস্পষ্ট ধারণা ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। পাশাপাশি যারা বিভিন্ন সরকারী সেবা প্রদান কাজে নিয়োজিত তারাও এই সকল বিধি-বিধান ও নীতিমালা সম্পর্কে যথেষ্ট ওযাকিবহাল নন। পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচারে অভিগম্যতা ও আইনগত সুরক্ষায় ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ একটি মাইলফলক। এই আইনে আইনগত সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। আদিবাসি, দলিত, লিঙ্গ বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরন্যায়বিচারে অভিগম্যতা ও আইনগত সুরক্ষায়‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই আইনের অধীনে ‘জেলা আইনগত সহায়তা প্রদান কমিটি’ জেলা পর্যায়ে আইনগত সহায়তার সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। জেলা আইনগত সহায়তা প্রদান কমিটি, সমাজসেবা অফিসার, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা, আইনজীবি এবং জেলা প্রশাসনের সাথে আদিবাসি, দলিত, লিঙ্গ বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কমিউনিটি ভিত্তিক সংগঠনগুলোর । ব্লাস্ট দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারী আইনগত সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা, যা দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী, শিশু এবং পুরুষদেরকে আইনী পরামর্শ, মধ্যস্থতা এবং মামলা দায়ের সংক্রান্ত আইনী সহায়তা দিয়ে থাকে। অসহায় মানুষকে আইনগত সহায়তা দানের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। এই সংগঠনে ৩০০ জন কর্মী এবং ২৫০০ জন সেচ্ছাসেবী প্যানেল আইনজীবী সম্পৃক্ত। বর্তমানে প্রধান কার্যালয় ছাড়াও সারা দেশে ১৯টি জেলায় জেলা কার্যালয় ও আইন সহায়তা ক্লিনিকের মাধ্যমে ব্লাস্ট আইন সহায়তা প্রার্থীদের নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত আইন সহায়তা দিয়ে থাকে। এটি তৃণমূল পর্যায়ে মানবাধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনী পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, মামলা ও মধ্যস্থতা পরিচালনা করে। ব্লাস্ট সাধারণত পারিবারিক, দেওয়ানী, ভূমির মালিকানা এবং সংবিধান বিষয়ক ইস্যুগুলো নিয়ে আইনী পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে থাকে। পাশাপাশি, আইন ও নীতি সংস্কারের মাধ্যমে মানুষের অধিকারের কার্যকর সূরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ব্লাস্ট গবেষণা এবং অ্যাডভোকেসী করে থাকে যার অংশ হিসেবে জনস্বার্থে মামলাও পরিচালনা করে। ব্লাস্ট লিঙ্গ, ধর্ম এবং প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক বৈষম্যরোধ করতে বিভিন্ন মামলা পরিচালনা করেছে। এছাড়াও ব্লাস্ট ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, প্রতিবন্ধিতা, যৌনতা ও পেশার ভিত্তিতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক চর্চা রোধে আইন সংস্কারের উদ্দেশ্যে নিয়মিত অ্যাডভোকেসী পরিচালনা করছে।