আবদুল জব্বার,পাবনাঃ
চারিদিকে প্রকৃতির সমারোহ। গণপ্রকৃতির মাঝে পাখিদের কিচির মিচির কোলাহল। আশপাশেও যেন শুনশান নীরবতা। মানুষের আনাগোনা না থাকায় পাখিগুলো যেন উন্মাদনায় ব্যস্ত। প্রকৃতিও যেন আপন রূপে রুপান্তিত হয়েছে। গণপ্রকৃতি যেন কিছুটা ঘন জঙ্গলের মতো। প্রকৃতির উন্মাদনায় মধ্যে খানিকটা ভীতিও ছড়াবে। ঝোপ-জঙ্গলে দেখা মেলে অচেনা কিছু পাখিদের, কুকুর-শিয়াল-সাপ সবকিছুরই দেখা মিলবে সেখানে, জমজমাট আসর বসায় অতিথি পাখিরাও।
পরিবেশটা যেন অনেকটা আশ্চর্য ও ভূতুরে ব্যাপার। এমন পরিবেশ দেখে গা ছমছম করলেও এর মাঝেই বাস আকাশ কলি দাস ও তার বোন ঝর্ণা দাসের। চারিদিকে ঘন জঙ্গলে ঘেরা আর তার মাঝখানেই ভাই-বোনের মাথাগোঁজার ঠাঁই। সাড়ে ৬ বিঘার জায়গাতে চার চালা ঘরটিও দুই শত বছরের পূরণো। আরেকটি ছোট দুইচালা ঘরে চলে ভাই-বোনের রান্নাসহ আনুসঙ্গিক কাজ। পাশে দুইটি গোয়াল ঘরও রয়েছে। বাড়ি-ঘরে ইট-পাথরে কোনও ছোয়া নেই।
পাবনার বেড়া উপজেলার কৈটোলা গ্রামে ভাই-বোনের এমন জীবনযাপন নানা রহস্যে ঘেরা। দুইজনই বিয়ে করেননি। ভাই আকাশ কলি দাসের বয়স ৮৬ বছর, আর বোন ঝর্ণা দাসের বয়স ৬১ বছর। ৫ ভাইবোনদের মধ্যে তারা দুইজন ছাড়া আত্মীয়-স্বজন সবাই ভারতে। কেউ সিলিগুড়ি কেউবা মুর্শিদাবাদ থাকেন। এখানে নিকট আত্মীয় বলতে তাদের কেউ নেই। ভাই আকাশের দেখা মিললেও সহজেই বোনের দেখা পান প্রতিবেশিরাও। দেখেই বোঝা যায়- বয়সের ভারের সঙ্গে পারকিনসন্সেও আক্রান্ত আকাশ কলি দাস। অনবরত চলে হাত-পা কাঁপুনি।
বাবা চন্দ্র কুমার দাস পাবনার নগরবাড়ির শ্রী নিবাস দিয়ার জমিদার বাড়ির নায়েব ছিলেন। ১৬-১৭ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হলে সংসারের হাল ধরেন। তিন ভাই-তিন বোনের সংসারে তিনিই অভিভাবক ছিলেন। ছোট বেলাতেই এক ভাইয়ের মৃত্যু হয়। বাকি একভাই ও দুইবোনকে স্বাধীনতার আগেই ভারতে বিয়ে দেন। বিয়ের পর তাদের মধ্যে আজও পর্যন্ত দেখা হয়নি।
সাদা-মাটা জীবন
চাহিদা, ইচ্ছা, খাবার, ভ্রমণসহ সব কিছুতেই তাদের জীবন রহস্য ঘেরা। বসতভিটায় সাড়ে ৬ বিঘার সম্পত্তির পাশাপাশি মাঠেও রয়েছে অর্ধ শতাধিক বিঘা জমি। এমন অঘেল সম্পদের মালিক হলেও দুইজনের দিনযাপন একেবারেও সাদা-মাটা। বাড়িতে তারা দুইজন একাই থাকেন। সম্পত্তি নিয়ে তার কোনও চিন্তা নেই। তাদের চিন্তা- তারা এসেছেন একা- যাবেন একা। তারা সম্পত্তি নিয়ে আসেননি, তাই সম্পত্তি নিয়েও যাবেন না। তাদের মৃত্যুর পর যার কপালে সম্পত্তি রয়েছে, তিনিই পাবেন। গরু ও মাঠের কাজে জন্য রাখাল ও শ্রমিকদের রাখলেও তারা দিনের আলোতেই বাড়ি ফিরে যায়। ঝড়-বৃষ্টির মাঝেও দুই ভাই-বোনের চিন্তাহীন জীবন। অসুখ-বিসুখও তাদের তেমন একটা হয় না বললেই চলে।
আদর্শ লালন করেন তাই জনপ্রকাশ্যে আসুক এমন কিছু বলতে ও করতে নারাজ। সম্প্রতি তার দুই একটা সাক্ষাৎকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় অনুশোচনা হয় তার। নতুন করে তাকে কেউ চিনুন এমনটা তিনি চান না। তাই সরাসরি সাক্ষাৎকার না দিলেও খোঁশকল্পে জানা গেল রহস্যঘেরা জীবনের খুব সামান্য অংশই।
বিয়ে রহস্য
আকাশ কলি দাসের দাবি- ঠিক কি কারণে তিনি বিয়ে করেননি তা তিনি জানেন না। আর বোন কি কারণে বিয়ে করেননি তাও জানে না! তবে সংসার জীবন পছন্দ হলেও ভাই-বোনদের বিয়ে ও দায়িত্ব নেয়ার কারণে বিয়ে করা হয়নি -এমনটা দাবি করলেও কথার মাঝে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। তবে বোনকে প্রথমে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও পরে রাজি না হওয়ায় তাকেও আর বিয়ে দেননি। নিরিবিলি জীবন কাটাতে তিনি বেশি সাচ্ছন্নবোধ করেন। এভাবে দুই ভাইবোনের চির কুমার-কুমারি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
একাকিত্বই তাদের ভালো লাগে। বোন ঝর্ণা দাস বেশির ভাগ সময় বই পড়ে সময় কাটান। ভাই আকাশ কলি দাস বইয়ের পাশাপাশি পশু-পাখি ও প্রকৃতির মাঝে সময় কাটান। তার একাকিত্বের কিছু সময় লাঘব করেন এই পশু-পাখি ও প্রকৃতি। লক্ষ্যবিহীন জীবন কাণ্ডারিবিহীন নৌকার মতো জীবন কাটিয়েই পার করতে চান।
পশুপাখি ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা
ভাই-বোনের পশুপাখি ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাও সবাইকে মুগ্ধ করেছে। সাড়ে ৬ বিঘার বসতভিটার পুরোটাই পাখিদের জন্য তিনি মুক্ত করে দিয়েছেন। ফলে জায়গাটি সরকারের পক্ষ থেকে পাখির অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। ইট-পাথরের নগরায়ণের ফলে পাখিরা যখন আপন নিবাস হারাচ্ছেন ঠিক তখন আশ্রয় নেয়া পাখিদের নিরাপদে থাকার জন্য নিজের বসত ভিটাই মুক্ত করে দিয়েছেন তিনি। কেউ সেখানে পাখি শিকারের চেষ্টা করলেও শক্তভাবে প্রতিরোধ করেন তিনি।
তার দাবি- পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। ফসল উৎপাদনেও অবদান রাখে। কিন্তু মানুষ এই পাখিগুলোকে নির্বিচারে হত্যা করছে। শিক্ষিত ও ধনীরা পাখিগুলোর উচ্চ মূল্যে কিনে খান বলেই অনেকে পাখি শিকার করতে উৎসাহী হোন। আমাদের দেশে যত পাখি আসে সব পাখি ফিরে যায় না। তাদেরকে হত্যা করা না হলে আমাদের দেশেও সারা বছরই এমন পাখিদের বসবাস থাকতো।
আকাশ কলি আগলে রেখেছেন শত বছরের পুরণো একটা লতা গাছ। তার দাবি- গাছটির নাম কেউ জানেন না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের প্রফেসর মনিরুল ইসলাম খান এসেছিলেন এই গাছ দেখতে তিনি সেই গাছের নাম দিতে পারেননি। এছাড়াও জার্মানি ও লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকরা এসেছিলেন তারাও এই গাছটির নাম জানাতে পারেননি।
দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা
ভাইবোন ভারতে পারি দিলেও দেশের প্রতি ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোয় এক সেকেন্ডের জন্যও তিনি বাংলাদেশ ছাড়েননি। ভাইবোনদের অনুরোধেও কখনও ভারতে যাওয়া হয়নি। ফলে ভাইবোনদের মধ্যে ৫০-৬০ বছর ধরে কোনও দেখা হয়নি। আশপাশের মানুষের বিপদের কথা শুনলেও ছুটে যান। টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করেন। অসহায় কেউ তার কাছে গেলে খালি হাতে ফেরান না। একারণে অর্ধশতাধিক বিঘার সম্পত্তির মালিক হয়েও ঋণের বোঝা রয়েছে।
সামাজিকতা ও রাজনীতি
কথাবার্তায় শালীনতা-শুদ্ধ ভাষা, তবে নিজেকে দাবি করেন স্বল্পশিক্ষিত। একসময় গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করলেও অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক আগেই। সামাজিকতায় সম্পৃক্ত থাকলেও এখন আর সেভাবে যান না। স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার পর আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে রাজনীতি করলেও সেখানেও একগুচ্ছ অভিমান। পাবনা ও দেশের রাজনীতির অনেক চড়াই-উতরাইয়ের স্বাক্ষীও তিনি। সেগুলোও তিনি কাউকে বলতে চান না।
এবিষয়ে কৈটোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহসিন উদ্দিন পিপল বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত দানশীল মানুষ, আদর্শিক মানুষ। উনার দানে অনেক ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত হয়েছেন। উনাকে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হয় এবং ভবিষ্যতেও দেয়া হবে। উনি আমাদের সঙ্গে আপনজনের মতোই থাকে। আমাদের এলাকার অনেক কিছুতেই তার অবদান রয়েছে।’
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহা. সবুর আলী বলেন, ‘আমি তার বিষয়ে কিছু জানি না। আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম। আমি অবশ্যই তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিবো। তারপর আমি বিষয়টি সম্পর্কে ও আমাদের করণীয় নিয়ে আপনাকে বলতে পারবো।’