// সঞ্জু রায়: মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক অন্যান্য যেকোন দেশের তুলনায় অনেক শক্তিশালী যা ভৌগোলিক কারণেও সারাবিশ্বে অনেক গুরুত্ব বহন করে। দুই দেশের ভাষা-সংস্কৃতি বহু যোগসূত্রের অংশীদার শুধু তাই নয় সার্বভৌমত্ব, পারস্পরিক আস্থা ও সমঝোতার ভিত্তিতে দুই দেশের মাঝে রয়েছে চমৎকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। আর এসব কারণেই বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যে সহজ শর্তে ঋণ বা লাইন অফ ক্রেডিটের (এলওসি) মাধ্যমে ভারত এখন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার।
ইআরডির সূত্র মতে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মাত্র ৫ মাসে বাংলাদেশের উন্নয়নে ১৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ প্রদান করেছে ভারত, যা বাংলাদেশের জন্য ভারতকে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদারে পরিণত করেছে। শুধু তাই নয় করোনাকালীন প্রতিকূলতায় যখন সারাবিশ্ব থমকে গিয়েছিল যেখানে ঋণের অর্থছাড় দেয়া যেকোন দেশের জন্যেই ছিল একটি চ্যালেঞ্জ সেখানেও বাংলাদেশের অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে এলওসি’র আওতায় সবচেয়ে দ্রুত অর্থ প্রদান করেছে ভারত যা ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ৬২% বেশি।
ভারতীয় হাইকমিশন ঢাকা সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ সালে লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ২২৮.৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করা হয়েছে যেখানে ২০২০-২১ সালে প্রদান করা হয়েছিল ১৪১.১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়াও ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত এলওসি’র আওতায় প্রকল্পসমূহের চুক্তিসমূহ ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে এবং মোট ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের মাইলফলকও অতিক্রম করেছে।
হাইকমিশন সূত্রে আরো জানা যায়, ভারত সরকার বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত ক্রয়ের জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ৯.৪৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেয়াতি অর্থায়ন এবং ৭.৮৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কনসেশনাল লাইনস অফ ক্রেডিট প্রদান করেছে। যার মধ্যে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কনসেশনাল ফাইন্যান্সিং স্কিম (সিএফএস) এর অধীনে। এলওসি তহবিল ব্যবস্থার অধীনে ভারত সরকারের মোট প্রতিশ্রুতির প্রায় এক-চতুর্থাংশ বাংলাদেশকে প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও দেশে ৪২টি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এলওসিভুক্ত প্রকল্পসমূহের মাঝে ১৪টি প্রকল্প ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকি ২৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রক্রিয়াধীন প্রকল্পের মাঝে বর্তমানে ৮টি প্রকল্প সক্রিয়ভাবে নির্মাণাধীন, ৯টি প্রকল্প রয়েছে ইপিসি টেন্ডারিং/চুক্তি পর্যায়ে, ২টি পিএমসি টেন্ডারিং-এ/চুক্তি পর্যায়ে, এবং ৯টি প্রকল্প প্রস্তুতি পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পসমূহের মাঝে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে রেলপথ, সড়ক ও পরিবহণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালন, অভ্যন্তরীণ জলপথ, বন্দর ও শিপিং, অর্থনৈতিক অঞ্চল, আইসিটি, রিনিউয়েবল এনার্জি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বিমান চলাচলের মতো বিভিন্ন সেক্টর। এছাড়াও বর্তমানে প্রায় ২.৪২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ১১টি প্রকল্প চুক্তি পর্যায়ে রয়েছে।
উল্লেখ্য, খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প ভারতীয় অর্থায়নে এলওসি-র অধীনে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোংলা বন্দরকে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করেছে। যার ফলে বাংলাদেশের জন্য এটি জেটি থেকে রেলপথের মাধ্যমে কনটেইনার ও কার্গো পরিবহণ সুবিধাসমন্বিত প্রথম বন্দর হয়ে উঠেছে যা দেশের অর্থনৈতিক খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নে বিশাল ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও ভারত সরকারের সিএফএস ফান্ডের অর্থায়নে রামপালে মৈত্রী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের ‘ইউনিট-১’ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে তাঁর কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং প্ল্যান্টটি এখন বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডের সাথে ইতিমধ্যেই সংযুক্ত হয়েছে। ভারতীয় হাইকমিশন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হওয়া প্রকল্পের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ইতিমধ্যেই লাইন অফ ক্রেডিটের আওতায় উভয় দেশের যৌথ উদ্যোগে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প শেষ হওয়ার পথে। এছাড়াও, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্প, ইন্ডিয়া বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন প্রকল্প, আশুগঞ্জ-জকিগঞ্জ/করিমগঞ্জে ড্রেজিং প্রকল্প, সিরাজগঞ্জ-দাইখোয়ায় ড্রেজিং প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসমূহের পাশাপাশি কমিউনিটি-কেন্দ্রিক বেশকিছু প্রকল্প অনুদানের আওতায় গৃহীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে যা বাস্তবায়িত হলে বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হবে বাংলাদেশে । আর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে ভারতীয় এসব ঋণ সহযোগিতা বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে মর্মে বিশ্বাস করেন দুই দেশের সংশ্লিষ্ট সকলেই।