এবাদত আলী
পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালি নিধনের যে নীল নকশা তৈরি করেছিলো তার নাম ছিলো‘ অপারেশন সার্চ লাইট ’। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই নীল নকশার অধিনেই ২৫ মার্চের মধ্যরাতে ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপুর্ণ শহর চট্রগ্রাম , রাজশাহী, খুলনা , যশোর , রংপুর , সৈয়দপুর , কুমিল্লায় একই সময় অপারেশন শুরু করে । নীল নকশার মুল নায়ক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর আগে রাতের আঁধারে ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডি পালিয়ে যান । অপারেশনের মূল দায়িত্বে রেখে যান বেলুচিস্তানে ঈদের জামাতে মুসলমান হত্যাকারি কুখ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে।
পুর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক মধ্য রাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র নিরপরাধ বাঙালিদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয় ।
একটি বিশেষ গ্রুপের (কমান্ড ) এক প্লাটুন সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি আক্রমণ করে । ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন আক্রান্ত হওয়ার আগে আগত সহকর্মি ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি ঘোষণা করেন ‘‘ আজ থেকে (২৬ মার্চ ) বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র । একে এখন যে করেই হোক রক্ষা করতে হবে ।’’রাত ১২-২০ মিনিটে তিনি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন । ঢাকা বেতার ততক্ষনে পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যাওয়ায় বলধা গার্ডেনে রক্ষিত ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তার স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন । ঘোষণা পত্রটি ছিলো ইংরাজী ভাষায় লিপিবদ্ধ । রাত ১-২০ মিনিটের দিকে বঙ্গবন্ধুকে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয় । তিন দিন পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
পাকিস্তানে কারারুদ্ধ অবস্থায় শেখ মুজিবকে সম্পুর্ণভাবে বহির্বিশ্ব থেকে আলাদা করে রাখা হয় । তারই ৭ মার্চের ভাষণে সাড়া দিয়ে বাংলার হাজার হাজার দামাল ছেলে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে শত্রু হননে নিজের জীবন বাজি রেখে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যায়। ৭ সেপ্টেম্বর ’৭১ পাকিস্তানের লায়ালপুর সামরিক জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে তাকে দেশদ্রোহি ঘোষণা করে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করা হয় ।
১১ নভেম্বর ১৯৭১’ সকাল ৮ টার দিকে ইয়াহিয়া খান , জুলফিকার আলী ভুট্টো ও জেনারেল আকবরের সামনে বঙ্গবন্ধুকে হাজির করা হলো । ইয়াহিয়া খানের ধারণা ছিলো শেখ মুজিব তার কাছে এসে প্রাণের ভয়ে নরম হয়ে যাবেন, এবং সেই সুযোগে তার কাছ থেকে আপোষের কথা পাওয়া যাবে। তিনি হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে । কিন্তু বঙ্গবন্ধু বললেন“ দুঃখিত ও হাতে বাঙালির রক্ত লেগে আছে।ও হাত আমি স্পর্শ করতে পারিনা ।”
মুজিবকে যখন দীর্ঘ ৯ মাস পর মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামিদের কক্ষ থেকে গৃহবন্দি হিসাবে স্থানান্তর করা হয় তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের নাটকীয় কোন পরিবর্তন ঘটেছে । ভুট্টো মুজিবকে দেখতে এলে মুজিব বিস্মিত হয়ে যান । ভু্েট্টা মুজিবকে বলেন আমি এখন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক । মুজিব পরিহাস করে বলেন, কখন তারা আপনাকে জেনারেল বানিয়েছে ? (কারা মুজিবের হত্যাকারি -লেখক এম, এল, খতিব) ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্তে মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয় ।
ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয় শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি । তিনি বাংলাদেশের স্থপতি , কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাকে বন্দি করে রাখার । সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের শান্তিকামি জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায় ।
বিশ্ব জনমতের কাছে নতি স্বীকার করে পাকিস্তান সরকার ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে । এদিন রেডিও পাকিস্তান থেকে মুজিবের ঢাকা প্রত্যাবর্তনের যাত্রা পথের বর্ণণা দেয়া হয় । এতে বলা হয় মুজিব প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহন করবেন , এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করবেন।
এখবর শোনার পর ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দে আত্মহারা হয়ে জয় বাংলা ধনীতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে । মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে ও আনন্দে নাচতে থাকে । শুরু হয় প্রতিক্ষার পালা । ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি প্রত্যুষে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয় এবং রাওয়ালপিন্ডি থেকে পি আই এর ভাড়া করা একটি বিমানে করে তাকে প্রথমে লন্ডনে নেয়া হয় ।
১০ জানুয়ারি সকাল ৮ টায় শেখ মুজিব লন্ডন থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পথে নয়াদিল্লীতে পৌঁছলে পালাম বিমান বন্দরে তাকে প্রানঢালা অভ্যর্থনা জানানো হয় । মুজিব ভারতের মাটিতে অবতরন করলে জয় বাংলা, শেখ মুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ এবং মুজিব দীর্ঘজীবি হোন প্রভৃতি পুর্ণ কন্ঠের উচ্চারণে তাঁকে সম্ভাষণ জানানো হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর একটি রাজকীয় বিমানে তিনি ঢাকার পথে যাত্রা শুরু করেন ।
এ দিকে বিজয়ের আনন্দে উন্মুক্ত ঢাকা । হাজার হাজার মানুষ হর্ষধ্বনি করছে ও নাচছে । ঢাকার সমস্ত লোক যেন বিমান বন্দর হতে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান ( রেস কোর্স ) পর্যন্ত সারা রাস্তায় জমায়েত হয়েছে । পার্শবর্তী জেলা এমন কি দেশের দুরবর্তী জেলা গুলো থেকেও হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে । তারা সকলেই বিজয় আনন্দে উদ্বেলিত ।
দুপুর ১-৪৫ মিনিটে ভারতীয় বিমান ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করলে হাজার হাজর মানুষ বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মত বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরে । আনান্দাশ্রুর বন্যা বয়ে যায় ।
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক সহযোগিদের সাথে একটি খোলা ট্রাকে চড়েন । ট্রাকটি ফুলে ফুলে ভরে উঠে । যাত্রা পথে জয় বাংলা ,জয় বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ জীবি হোন , উল্লসিত চিৎকার এবং বাংলাদেশ বাংলাদেশ শব্দের ছন্দময় গান ধ্বনিত হতে থাকে ।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তখন জনস্রোতে কানায় কানায় পুর্ণ । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন জনতার উদ্দেশ্যে বলেন “ আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন । আমার সারা জীবনের আশা আকাংখ্যা পরিপুর্ণ । ” তিনি আবেগ আপ্লুত কন্ঠে বলেন “ রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বলেছিলেন সাতকোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি । মুজিব বলেন এটি চিরন্তন সত্য নয় । বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বকে প্রমাণ করে দিয়েছে তারা বীরের জাতি । ” তিনি বলেন , তার মৃত্যুদন্ডাদেশ মঞ্জুর হয়েছিলো এবং তার জন্য একটি কবর খোঁড়া হয় ; কিন্তু তবুও তিনি করুণা ভিক্ষা চাননি । পাকিস্তানিদের কাছে মাথা নত করেননি । তিনি তাদের বলেছিলেন “ তোমরা চাইলে আমাকে হত্যা করতে পারো কিন্তু আমার মৃত দেহটি বাংলার মাটিতে পাঠিয়ে দেবে । মুজিব কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কান্না দমন করে বল্লেন “ আজ আমার আর কিছু বলার নেই ”। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।