।। আবদুল জব্বার।।
মাত্র ২০ হাজার টাকা পূজি দিয়ে শুরু করে সততা, নিষ্ঠা, শ্রম, মেধা ও শৃংখলাকে সম্বল করলে একজন মানুষ যে কত উপরে নিয়ে যেতে পারেন তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্কয়ার গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরী। যিনি প্রচন্ড আস্থা ও মনোবলকে পূঁজি করে শুন্য থেকে শিখরে উঠেছিলেন।
এ দেশের শিল্প ও ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্রে যার অবদান প্রশংসনীয়। প্রতিকুল অবস্থাকে পাশ কাটিয়ে শুন্য থেকে স্কয়ার গ্রুপ যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশের মধ্যে শীর্ষে উঠে এসেছেন তিনি হলেন প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী। আজ ৫ জানুয়াারি তার এগারতম মৃত্যুবার্ষির্কী। দেশ বরেণ্য এই শিল্পপতির মৃত্যু দিবসে তার পরিবারের পক্ষ থেকে পাবনার এষ্ট্রাস খামার বাড়ীতে প্রার্থণা সভা এবং সন্ধ্যায় পাবনা প্রেসক্লাব স্মরণ সভার আয়োজন করেছে।
স্কয়ার সুত্র জানায়, ছোটবেলা থেকেই ব্যবসার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। প্রথমে নিজে বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে তৈরি করেন ‘ই-সনস’ নামক ঔষধ তৈরির কারখানা। পরে বাবার কাছ থেকে পুঁজি নিয়ে নেমে পড়েন ফার্মেসি ব্যবসায়। চার বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন স্কয়ার ফার্মেসিউটিক্যাল ওয়ার্কস নামে ওষুধ কারখানা। স্কয়ার আজ বাংলাদেশে শীর্ষ স্থানীয় শিল্প গ্রুপ। আর এর স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন স্যামসান এইচ চৌধুরী। ৬৫ বছর আগে স্যামসান এইচ চৌধুরীর নেতৃত্বে চার বন্ধু মিলে পাবনা শহরে শালগাড়িয়া এলাকায় যে ছোট্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটি আজ মহিরুহ। ১৯৫৮ সালে যে প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্কয়ারের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার নাম ছিল স্কয়ার ফার্মা। পুঁজির পরিমাণ ছিল মাত্র ২০ হাজার টাকা। ১৯৬৪ সালে স্কয়ার ফার্মা নাম পরিবর্তন করে করা হয় স্কয়ার ফর্মাসিউটিক্যাল লিঃ। ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ছিমছাম ছিল কারখানাটি। এখনও স্কয়ারের প্রত্যকটি কর্মকান্ডে এ ব্যাপারটি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে আছে ছিমছামভাব ও স্বচ্ছতা। আছে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। কঠোর নিয়মের মধ্যে দিয়ে চলছে সবকিছু। স্কয়ার নামের মহত্ব আরও অনেক গভীরে। সেদিন চার বন্ধু মিলে আট হাতে গড়ে তুলেছিলেন এক বর্গাকার চতুর্ভুজের। স্কয়ার মানে হচ্ছে সেই বর্গাকার চতুর্ভূজ। কিন্তু পারফেক্ট না হলে যেমন চতুর্ভূজ বর্গাকার হয় না। তেমনি নৈতিক বিশুদ্ধতা না থাকলে জীবনে সাফল্য লাভ করা যায় না। সেই পারফেক্টের চিন্তা থেকেই তাদের গ্রুপের নামকরণ করা হয় স্কয়ার। এ প্রসঙ্গে স্যামসান এইচ চৌধুরী ঐ সময় বলেছিলেন, “স্কয়ার মানেই পারফেকশন। এ জন্যই আমরা নাম রাখলাম স্কয়ার”। স্যামসন এইচ চৌধুরীর স্ত্রী অনিতা চৌধুরী যিনি গত ১৩ নভেম্বর তিনি পরলোক গমন করেন। তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে স্যামুয়েল এস চৌধুরী (স্বপন চৌধুরী), যিনি বর্তমানে স্কয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান, মেঝ ছেলে তপন চৌধুরী স্কয়ার ফার্মাসিটিউক্যালস এবং স্কয়ার হাসপাতালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ছোট ছেলে অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু মাছরাঙা টেলিভিশন, স্কয়ার টয়লেট্রিজ স্কয়ার ফুড এন্ড বেভারেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। একমাত্র মেয়ে রতœা পাত্র স্কয়ার গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তারা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সু-প্রতিষ্ঠিত।
১৯৮৮ সাল থেকে ওষুধের পাশাপাশি স্কয়ার গ্রুপও নতুন শিল্প স্থাপন শুরু করে। ওই সময়ে স্কয়ার ফার্মার একটি আলাদা বিভাগ হিসাবে স্থাপন করা হয় স্কয়ার ট্রয়লেটিজ লিঃ এর থেকে একে একে স্থগিত হতে থাকে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৫ সালে স্কয়ার টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ শুরু করে। স্কয়ার সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ টেক্সটাইল খাতে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কনজুমার পণ্য। এ দুটি খাতে তাদের প্রভৃতির হার ঈর্ষর্ণীয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে স্কয়ার ফার্মেসিউটিক্যাল লিঃ, স্কয়ার স্পিনিংস লিঃ, স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিঃ, স্কয়ার কনজিউমার প্রোডাক্টস লিঃ, স্কয়ার ফুড এন্ড বেভারেজ, স্কয়ার এভিয়েশান লি. স্কয়ার ইনফারমেটিক্স লিঃ, স্কয়ার সারাহ নিড ফেবিক্স লিঃ, স্কয়ার হসপিটালস লিঃ, স্কয়ার এগ্রো লিঃ, স্কয়ার হারবাল এন্ড নিউট্রিসিটিক্যাল লিঃ, এজিএস সার্ভিসেস লিঃ, মাছরাঙা প্রডাকশন লিঃ, ফার্মা প্যাকেজস লিঃ, বর্ণালী প্রিন্টার্স লিঃ, মিডিয়া কম লি. ও মাছরাঙা টেলিভিশন। এ ছাড়া হাউজিং কোম্পানী শেলটেক, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে স্কয়ার গ্রুপের শেয়ার রয়েছে।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী স্যামসন এইচ চৌধুরী ১৯২৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার কাশীয়ানী থানার আড়–য়াকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তারা বাবা ছিলেন ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী। স্যামসন চৌধুরী ভারতে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৫২ সালে পাবনা জেলার আতাইকুলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার পিতা ছিলেন একটি ফার্মেসীর মেডিকেল অফিসার। তিনিসহ ১৯৫৮ সালে গড়ে তোলেন স্কয়ার ফার্মাসিটিউক্যালস। বর্তমানে স্কয়ার ফার্মায় ৩০ হাজারসহ স্কয়ার গ্রুপের ৬০ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছে। স্যামসন চৌধুরী ঢাকার ঐতিহ্যমন্ডিত প্রাচীণ মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি (এমসিসিআই) এর সাবেক সভাপতি, মাইডাসের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফার্মাসিটিউক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশানের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বাংলাদেশ পাবলিক লিসটেড কোম্পানীজ অ্যাসোসিয়েশন, চেয়ারম্যান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লি:, ঢাকা ক্লাবের আজীবন সদস্য, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক, এক্সিকিউটিভ মেম্বর বাংলাদেশ ফ্রাঞ্চ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি (আইসিসিআই), উপদেষ্টা ও সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতি, প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ হারবাল প্রোডাক্টস প্রস্তুতকারক সমিতি, চেয়ারম্যান মিউচুয়্যাল ট্রাষ্ট ব্যাংক লিমিটেড, সাবেক চেয়ারম্যান ও টাষ্ট্রি (টিআইবি), চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহবাজপুর টি এষ্টেট লি, পাবনা প্রেসক্লাবের জীবন সদস্য ছিলেন।
এ ছাড়া স্যামসন চৌধুরী ১৯৯৮ সালে আমেরিকান চ্ম্বোর কর্তৃক বিসনেজ এক্সিকিউটিভ অব দি ইয়ার, ২০০০- ২০০১ সালে ডেইলি স্টার এবং ডিএইচএল কর্তৃক বেষ্ট এন্টারপ্রেনার অব দি কান্ট্রি, ২০০৩ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংক এওয়ার্ড লাভ করেন, ২০০৫ সালে ব্যাংকার্স ফোরাম এওয়ার্ড লাভ করেন, ২০০৬ সালে আইসএবি ন্যাশনাল এওয়ার্ড লাভ করেন, ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে পর পর দুই বছর দেশের সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৫ সাল থেকে পর পর বেশ কয়েকবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক সেরা করদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পান। ২০০৯ এবং ২০১০ সালে সিআইপি মনোনীত হন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরে তিনি পরলোকগমন করেন। তাকে পাবনা শহরের উপকন্ঠ বৈকন্ঠপুরের বাসভবন এস্ট্রাসে সমাহিত করা হয়।
দেশের শীর্ষ শিখরে পৌছুলেও ভুলে যাননি অতীত। তিনি পাবনাকে খুব ভাল বাসতেন। তিনি পাবনার অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীর আধুনিকায়ন করেন। বনমালি ইন্সটিটিউট, পাবনা প্রেসক্লাবসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তিনি সহায়তা করেন। তিনি ছিলেন, পাবনা প্রেসক্লাবের সম্মানিত জীবন সদস্য। এ ছাড়া পাবনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রয়েছে তার অবদান। তিনি পরলোকে চলে গেলেও এ সব প্রতিষ্ঠান তাকে স্মরণ করবে চীরকাল। দেশ বরেণ্য এই শিল্পপতির মৃত্যু দিবসে তার পরিবারের পক্ষ থেকে পাবনার এষ্ট্রাস খামার বাড়ীতে প্রার্থণা সভা এবং পাবনা প্রেসক্লাব বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় স্মরণ সভার আয়োজন করেছে।