নাটোর প্রতিনিধি- নাটোর জেলায় ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে আখের সাথে সাথী ফসলের চাষ। একই সাথে একাধিক ফসল রোপন করায় উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় রোপনকৃত ফসল এর উৎপাদন বেশি হয়। অথনৈতিকভাবে স্থানীয় কৃষকরা অধিকহারে লাভবান হওয়ার ফলে আখের সাথে সাথী ফসল চাষ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। বাড়ছে আখের আবাদ। বাজারে চাহিদা থাকায় ভালো দামও পাচ্ছেন চাষিরা। লাভবান হওয়ায় চাষিদের মুখে হাসি ফুটেছে । ক্রাসারের মাধ্যমে আখ থেকে গুড় তৈরীর অনুমতি দিলে এই খাতে চাষাবাদ আরও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছে, আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণের কারণে আশানুরূপ ফলন ও বাজারে বেশ চাহিদা থাকায় দিন দিন আখ চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। তবে কৃষকরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অচিরেই অধিক হারে পতিত জমিতে চাষ আরও সম্প্রসারণ সম্ভব।আখ একটি রসালো ও মিষ্টি জাতের খাবার। এ জেলার আখ খেতে খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় সব জেলার মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয়। তাই স্থানীয় মানুষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অন্যান্য জেলায়ও সরবরাহ করা হচ্ছে এখানকার আখ।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, একসময় নাটোরের আখের খ্যাতি ছিল। এখানকার আখের উপর ভিত্তি করে জেলায় দুটি চিনির কলও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং দেশের সবচেয়ে বড় গুড়ের বাজার গড়ে উঠেছিল । কিন্তু বছরের পর বছর চিনিকলগুলো লস খাওয়ায় এবং সঠিক সময়ে কৃষকদের আখের দাম পরিশোধ না করাসহ নানা কারণে আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন কৃষকেরা। এতে করে আখের জায়গা দখল করে নেয় অন্যান্য ফসল। তবে এখন আখের চাহিদা বাড়ছে। বাজারে ন্যায্য মূল্যও পাওয়া যাচ্ছে। ফলে অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি লাভ হওয়ায় দীর্ঘ দিন পর আবারও আখ চাষের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বেলে ও বেলে-দোআঁশ মাটি আখ চাষের জন্য উপযুক্ত। ৭/৮ মাসেই আখের ফলন পাওয়ায়। এক মৌসুম আখ উৎপাদনে ২ মৌসুম ধানের সময় লাগলেও সার্বিকভাবে আখ চাষে লাভবান হচ্ছে কৃষক। আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণের কারণে আশানুরূপ ফলন ও বাজারে বেশ চাহিদা থাকায় দিন দিন আখ চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। আখের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে ডাল জাতীয় ফসলের মধ্যে মটরশুঁটি, ছোলা, মসুর, মুগ ও মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ, রসুন এবং তিল, তিসি, সরিষা, বাদাম, মিষ্টি কুমড়া, আলু ইত্যাদি চাষ করা যায়।আখ চাষীরা জানায়, আখের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে ডাল জাতীয়, তেল জাতীয় ফসলগুলো আলাদা জমি ছাড়াই বিনা সেচে বৃষ্টি নির্ভর অবস্থায় চাষ করা যায়। ফলে এককভাবে আখ চাষের চেয়ে অনেক লাভজনক। সাথী ফসল হিসেবে ডাল জাতীয় ফসল চাষে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আখ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সাথী ফসল থেকে আংশিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়। পেঁয়াজ ও রসুনের পাতায় তীব্র ঝাঁঝ থাকায় সাথী ফসল হিসেবে আখ চাষ করলে আখে পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। আখের সঙ্গে সাথী ফসল চাষ করলে জমিতে আগাছা কম হয় ফলে মূল ফসলের ফলন অনেকাংশে বেড়ে যায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অচিরেই অধিক হারে পতিত জমিতে চাষ আরও সম্প্রসারণ সম্ভব বলে মনে করেন কৃষকরা।
জানা যায়, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) কর্তৃক কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদেরকে সহায়তাকল্পে ‘‘আখের সাথে সাথী ফসল হিসাবে ডাল, মসলা ও সবজি জাতীয় ফসল উৎপাদন প্রকল্প’’ নামে ৩ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০২১-২২ অর্থ বছরের ১৫টি সুগার মিল এলাকায় এই প্রকল্প কাজ শুরু হয়েছে। এবার রোপণ মৌসুমে ৫০টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়।অপরদিকে নাটোর কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার ১৪হাজার ৭শ,৩৭ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ১০হাজারের বেশি জমিতে আখের সাথে সাথী ফসল আবাদ করেন কৃষক।
এদিকে নাটোর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএসআরআই এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাসিবুর রহমান বলনে, ২০২১-২২ রোপণ মৌসুমে নাটোর জেলায় এই প্রকল্পের মোট ৭০টি (প্রতিটি প্লট ১বিঘা) প্রদর্শনী প্লট রয়েছে যা প্রায় ১০ হেক্টর এবং ২০২২-২৩ রোপণ মৌসুমে জেলায় ১৭৫টি (প্রায় ২৩ হেক্টর) প্রদর্শনী প্লট স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। প্রতিটি প্লটের জন্য কৃষককে প্রকল্প হতে বীজ আখ, সাথী ফসলের বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও সেচ, জমি তৈরি, নালা তৈরি ইত্যাদি কাজের জন্য শ্রমিক খরচ দেয়া হয়। এর ফলে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন এবং আখ চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বড়াইগ্রাম উপজেলার মহিষভাঙ্গা গ্রামের কৃষক কাশেম সরকার জানান, আমি ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে আখের সঙ্গে সাথি ফসল পেঁয়াজ চাষ করে ৫০ মণ পেঁয়াজ পেয়েছি যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা। পেঁয়াজ উত্তোলনের পর ২য় সাথি ফসল মুগডাল চাষ করে ৩ মণ মুগডাল পেয়েছি। এছাড়াও আমি ১ বিঘা জমি থেকে বিএসআরআই আখ ৪২ (রং বিলাশ) জাতের ৮০০০ টি চিবিয়ে খাওয়া আখ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন।
নলডাঙ্গা উপজেলার হরিদা খলসি গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিম জানান, আমি এ বছর প্রথম ১ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে এই প্রকল্পের সহায়তায় আখের সঙ্গে সাথি ফসল আলু চাষ করে ৪০ মণ আলু পেয়েছি যার বাজার মূল্য প্রায় ৪০ হাজার টাকা। আলু উত্তোলনের পর ২য় সাথি ফসল মুগডাল চাষ করে ২.৫ মণ মুগডাল পেয়েছি। এছাড়াও আমি ১ বিঘা জমি থেকে বিএসআরআই আখ ৪২ (রং বিলাশ) জাতের ৭০০০ টি চিবিয়ে খাওয়া আখ ১ লাখ টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছি।
নাটোর সদর উপজেলার তেলকুপি গ্রামের কৃষক আব্দুস সামাদ প্রামাণিক বলেন, প্রকল্প থেকে সাথি ফসল ও আখ চাষের যাবতীয় খরচ পেয়েছি। আমি ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে আখের সঙ্গে সাথি ফসল আলু চাষ করে প্রায় ৪০ মণ আলু পেয়েছি যার বাজার মূল্য অর্ধ লক্ষ টাকার উপরে। এছাড়াও আখ বিক্রি করে ভালো লাভবান হবেন বলে তিনি মনে করেন।
এছাড়াও উপকারভোগী অন্য কৃষকরা বলছেন, এ প্রকল্প চলমান থাকলে অনেকেই আখ চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন এবং আখের আবাদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
এবিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ড. আবু তাহের সোহেল বলেন, সার, কীটনাশক, বীজ, মসলাসহ চাষাবাদ সামগ্রী আলাদা আলাদা ভাবে ক্রয় করে কৃষককে সরবরাহ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক নিজেই শ্রমিকের কাজ করেন সেক্ষেত্রে কীটনাশক ও সার প্রয়োগ, নালা তৈরিসহ ফসল সংগ্রহে শ্রমিকের মজুরী বাবদ যে অর্থ সেটি কৃষককে দিয়ে দেয়া হয়। সাথী ফসল চাষ করিয়ে কৃষকদের আর্থিক ভাবে লাভবান করানোই হচ্ছে এই প্রকল্পের মুল লক্ষ্য।