পাবনার সিংহ পুরুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল এর সাক্ষাৎকার- ১১

এবাদত আলী
(পুর্ব প্রকাশের পর)
(পাবনার মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জল নক্ষত্র, পাবনার সিংহ পুরুষ নামে খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল মৃত্যুবরণ করেন ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। তার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয় ১৯৯৫ সালের ২৭ ও ২৮ মে তারিখে। যা নি¤েœ হুবহু তুলে ধরা হলো।)।
“সাক্ষাৎকার”

পাবনার নকশালেরা তখন পাক আর্মিদের সঙ্গে ডিগ্র্রিকলেজ ক্যাম্পে একত্রে থাকতো। পাক আর্মিগণ কোন অপারেশনে গেলে নকশালদেরকেও সঙ্গে নিয়ে যেত। অপরদিকে নকশালেরা কোন বিপদে পড়লে পাক আর্মিরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতো। পাবনার নকশালদের উৎখাতের জন্য আমরা পরিকল্পনা করতে থাকি। সানিক দিয়ার চর এলাকা ছিল তখন নকশালদের পুরো ঘাঁটি। এই এলাকা অপারেশনের জন্য নীলু, আব্দুল হাই ও হাবু চেয়ারম্যানের উপর বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। নকশালদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করতে গিয়ে সেলিম ও আব্দুল হামিদ মারা যায়। কিছু সংখ্যক নকশাল স্থানীয় একটি পাকা দালান বিশিষ্ট স্কুল ঘরে আশ্রয় নেয়। সে সময় আর,সি,এল গান আমাদের সঙ্গে না থাকায় তাদেরকে প্রতিহত করা সম্ভব হয় না। এর পর খবর পেয়ে পাক হানাদার বাহিনী নকশালদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। গ্রামের লোকদের বাড়ি ঘরে আগুন দেয় এবং বহু সংখ্যক নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করে। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর নকশাল, রাজাকার এবং বদর বাহিনীরা নাজিরপুর গ্রামে প্রবেশ করে গোটা গ্রামটিই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে হাত ও পা হ্যাচকা টানে ছিড়ে ফেলে। তারা অগণিত লোককে হত্যা করে। পাবনায় মওলানা আব্দুস সোবহানের নেতৃত্বে রাজাকার পরিচালনা করা হতো। ক্যাপ্টেন জায়েদী, নুরু খন্দকার, ওসমান গণি খান ছিলেন তার সহযোগী। মওলানা ইসহাক ছিলেন সে সময় শিক্ষামন্ত্রী। পাবনা জেলায় হাদল ডেমরা, গোড়রী সহ বিভিন্ন গ্রামে পিস কমিটি রাজাকার বাহিনী ও নকশালদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা চালায় ও গ্রামের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তারা আমার শাহজাদপুরের চিথুলিয়ার বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। নকশালদের পক্ষে টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বই ছিল প্রধান। পাবনার উল্লে¬খযোগ্য রাজাকার ছিল সাবান মল্লিক ও ঘেটু রাজাকার। মুক্তিযোদ্ধা মতিউর, মান্নান, পল্টু, রাজাকারের হাতে ধরা পড়ে।
রাজাকাররা বাঁশের খুটির প্যারেক বানিয়ে তাদেরকে চিৎ করে শুইয়ে কন্ঠনালী ভেদ করিয়ে খুঁটি মাটিতে পুঁতে দেয়। সারাদিন ধরে অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে তাদের মৃত্যু ঘটে। কুচিয়ামোড়াতে তাদের কবর আছে।
আমাদের সর্বশেষ যুদ্ধ ছিল সুজানগরে। আমার নেতৃত্বে ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে সুজানগর থানার তিন দিক থেকে আক্রমণ করা হয়। এক দিকে এ্যাম্বুশ পেতে এলাকাটি ফাকা করে রাখা হয়। ভোর ৬টার দিকে আক্রমণ শুরু করা হয়। থানায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল গুলিতে আহত হলে তাকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হয়। যুদ্ধে ইব্রাহীম আলী (দুলাল) শহীদ হয়। উলট গ্রামের আবু সাইদের চোখে গুলি লেগে দু চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ১৩ তারিখ রাত ৯টার সময় থানার পশ্চিম পাশের বাংকারে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয় দ্বীপচরের আবু বকর। এই যুদ্ধে জহুরুল ইসলাম বিশু গুলি বিদ্ধ হয় এবং তাকে ভারতে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য। এ সময় ৪জন পাক আর্মি নিহত হয়। বাদ-বাকি সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর ভোর বেলা সুজানগর থানা মুক্ত করা হয় এবং থানার দায়িত্ব ইকবালের উপর ন্যস্ত করা হয়।
মুজিব বাহিনী ও মুক্তি বাহিনী আমার নেতৃত্বে একক কমান্ডে এক সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। কোন কোন স্থানে মুজিব বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর মধ্যে মত বিরোধ ছিল বলে শোনা গেলেও পাবনাতে এ ধরনের কোন সমস্যা ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় গোটা পাবনাতে কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে রফিকুল ইসলাম বকুল বলেন মতিউর, মান্নান, পল্টু, সেলিম, হামি, দুলাল, রিদ্দিক, আসাদ, ইদ্রিস, সাধন, স্বপন, সাচ্চু, সফি, দিলু, গামা, আলে¬ক, বারেক, নুরু, মতি, বুলবুল, পল্টুসহ প্রায় ৯৫জন। স্বাধীনতা বিরোধী উলে¬খ্যযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে কে বা কারা ছিলেন যাদেরকে মুক্তি বাহিনীরা হত্যা করেছে? তিনি বলেন ওসমান গনি, নুরু খন্দকার, ডাঃ মোফাজ্জাল হোসেন প্রমুখ ব্যক্তিগণ নাটোরে আত্মগোপন করেছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পরে মুক্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তারা নিহত হয়। এক পর্যায়ে রফিকুল ইসলাম বকুলকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, আপনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আপনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব পাবনার মানুষকে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন এবং পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন এজন্য পাবনার মানুষ আপনাকে সিংহ পুরুষ এবং বীর বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। সরকারি তরফ হতে তেমন কোন খেতাব বা সম্মানে আপনাকে কি ভুষিত করা হয়েছে? প্রতি উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘দীর্ঘ ২৪ বছরেও যখন হয়নি তখন আর কবে হবে? কি প্রয়োজন। দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে একজন সৈনিক হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিতে পারছি এটাই তো যথেষ্ট।’ (সমাপ্ত) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।