পাবনার সিংহ পুরুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল এর সাক্ষাৎকার- ৭

এবাদত আলী
(পুর্ব প্রকাশের পর)
(পাবনার মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জল নক্ষত্র, পাবনার সিংহ পুরুষ নামে খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল মৃত্যুবরণ করেন ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। তার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয় ১৯৯৫ সালের ২৭ ও ২৮ মে তারিখে। যা নি¤েœ হুবহু তুলে ধরা হলো।)।
“সাক্ষাৎকার”

পাক আর্মিরা জজকোর্ট ও পোষ্ট অফিস থেকে পাবনা পুলিশ লাইনের পুলিশদের উপর আক্রমন করে চলেছে, আর আই আবুল খায়েরের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী প্রাণপণ লড়াই করে চলেছে। আমাদের মধ্য থেকে দু একজন যোদ্ধা অতি সাহসি মনোভাব নিয়ে সামনের দিকে এগুতে থাকে। এ সময় পাক আর্মিদেরকে তীর দ্বারা আঘাত হানতে গিয়ে অজ্ঞাতনামা এক যুবক শহীদ হয়। জজ সাহেবের বাড়ীর পাশে বেশ বড় ধরনের একটি ড্রেনের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আমি অগ্রসর হতে লাগলাম।

এগিয়ে গিয়ে দেখি পৌরসভা আর আমজাদ সাহেবের বাড়ির মাঝখানের রাস্তার উপর দিয়ে একটি জীপ গাড়ি আসছে। হাতের টুটুবোর দিয়ে ফায়ার করা মাত্র সামনের কাচ ভেঙ্গে ড্রাইভার আহত হয় এবং জীপটি উল্টে খাদে পড়ে যায়। পাক আর্মিরা দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। পুলিশ লাইনের যুদ্ধ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। পাক আর্মিরা সেখান থেকে বাণী সিনেমা হলের পাশে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অভ্যন্তরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদিকে পাবনা জেলার সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়লে লোকজন চারিদিক থেকে লাঠি ফলা, সড়কি বন্দুক ও তীর ধনুক নিয়ে জয় বাংলা শে-াগান দিতে দিতে স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধাদের পাশে এসে হাজির হয়।
আর, আই, আবুল খায়ের আমাদেরকে নিয়ে গিয়ে পুলিশ লাইনের ভিতরের অবস্থা দেখান। এ সময় জেলখানার তালায় গুলি করে তালা ভেঙ্গে ফেলা হলে কয়েদীরা মুক্ত হয়ে বাইরে চলে আসে। ডান্ডাবেড়ী পরানো কয়েদীর ডান্ডা ঝন ঝন শব্দ হতে থাকে। তখন পাবনার ম্যাগজিন রুম খুলে দেওয়া হলে স্বেচ্ছাবেসী যুবক ও জনসাধারনের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। পাক আর্মি টেলিফোন ভবনে আশ্রয় নিয়ে আছে। এ খবর পাবার পর সংগ্রামী জনতা তাদের উপর চারিদিক থেকে আক্রমণ করে বসে। বিভিন্ন স্থান থেকে পাক আর্মিদের উপর ব্যাপকভাবে হামলা করা হয়। তাদের উদ্দেশ্যে পেট্রোল বাল্ব ছুড়ে মারা হলে ভয়ে তারা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জানালা দিয়ে গুলি চালাতে থাকে। এ সময় গোবিন্দা মহল্লার রহিম ব্ল্যাকার (বাণী সিনেমা হলের টিকেট ব্ল¬্যাককারি) আম গাছ বেয়ে ছাদে উঠে সেখান থেকে একটি এস এম জি নিয়ে আসে। চাইনিজ এস এম জিটি তার কাছ থেকে নিয়ে ঝংকারের মালিক হাবুল ভাই বাণী সিনেমার ছাদে পেতে গুলি চালাতে থাকে। আমার হাতে ও ইকবালের হাতে টুটুবোর এবং অন্যান্যদের কাছে ছিল ৩০৩ রাইফেল।
এক সময় পেট্রোল বাল্ব ছোড়া হলে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের জানালায় আগুন ধরে যায়। যে সকল পাক সেনা গুলি করতে করতে বারান্দায় এসেছিল তারা তখন ভয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এ সময় বারান্দায় পেতে রাখা অপর একটি এস এম জি আমি নিজের দখলে নিয়ে আসি। এরপর অন্যান্য বন্দুকের গুলির পাশাপাশি দুটো এস এম জির গুলির আক্রমণে খান সেনা ব্রাশ ফায়ার করতে করতে বাড়রি পাশ দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় গোপালপুরের গুনাইয়ের বাপ তাদেরকে লাঠি নিয়ে মারতে গেলে তাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়লে সে নিহত হয়। তখন চারিদিক থেকে সাধারণ মানুষ তাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং লাঠি ফালা ও অন্যান্য অস্ত্র শস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। অবস্থা বেগতিক দেখে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অভ্যন্তর হতে পাক বাহিনীর সদস্যরা চিৎকার করে বলতে থাকে “ইহাপর কুই ইপি আর সোলজার হায়? ইহাপার কুই পুলিশ হায় হামলোক সারেন্ডার করনা চাহতা হায়”। কিন্তু কে শোনে কার কথা যে যেভাবে পারলো তাদেরকে হত্যা করলো। সেখানে প্রায় ২৮/৩০ জন খান সেনাকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। এর পর হাজার হাজার জনতা স্বতঃস্ফুর্তভাবে শহরে মিছিল বের করে জয় বাংলা ধ্বনি দিতে থাকলে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।

(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।