এবাদত আলী
(পুর্ব প্রকাশের পর)
(পাবনার মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জল নক্ষত্র, পাবনার সিংহ পুরুষ নামে খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল মৃত্যুবরণ করেন ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। তার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয় ১৯৯৫ সালের ২৭ ও ২৮ মে তারিখে। যা নি¤েœ হুবহু তুলে ধরা হলো।)।
“সাক্ষাৎকার”
নকশাল নামধারী সেই উগ্রপন্থীরা সানিক দিয়ার চর এবং তিনগাছা বাবুর বাগানে থাকতো। তারা ছাত্র নেতা মোহম্মদ নাসিমকে পবনা শহরে দেহের ১৯ জায়গায় ছুরিকাঘাত করে নাড়ি ভুঁড়ি বের করে ফেলে। তাকে পাবনা হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয় এবং তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। ইতোমধ্যে পাবনাতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে ছাত্রলীগের সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে পাবনা জিলাস্কুলে ক্যাডেট কোরের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
এক্স আর্মি আব্দুল হাই, নগরবাড়ীর কাদের ও পৈলানপুরের আব্দুস সাত্তার লালু এই তিনজন মিলে প্রশিক্ষণ প্রদান করতো। জিলা স্কুলের হেড মৌলানা কছিমুদ্দিন স্যার (শহীদ ১০ জুন ১৯৭১) সিভিল ডিফেন্সের সরঞ্জামাদি দিয়ে আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ২৩ মার্চ ১৯৭১ পাবনাতে ব্যাপক মহড়া গণমিছিল ও বিশাল জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। পাবনা টাউন হল প্রাঙ্গনে পাকিস্তানি পতাকা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। আমি পতাকা উত্তোলন করি। তখন আমার পাশে ছিল ইকবাল ও জহুরুল ইসলাম বিশু। এরপর পাবনা পুলিশ মাঠে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের এক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ মার্চ রাতের বেলা পৈলানপুর ইয়াকুব মিয়ার বাড়ির উপর একটি সালিসকে কেন্দ্র করে মারামারি হয়। এই মারামারির সঙ্গে নকশালেরা জড়িত ছিল বলে ইকবালের টুটু বোর সহ পাইপগান নিয়ে উজ্জ্বল, সেলিম, নাসু, শফি, কাফী সহ অনেকে এক সঙ্গে হয়ে নকশালদের ঘাঁটি বলে পরিচিত রাধানগর মাসুদের বাড়িতে আক্রমণ করে। সেখানে কৃষ্ণপুরের শুকুর আলী গুলিতে মারা যায়। এরপর সকলে ইছামতি নদীর পারে গিয়ে একত্রিত হয়ে নকশাল দমনের জন্য পরিকল্পনা করা হয়। গোলাম কাদেরীও উক্ত পরিকল্পনার সময় উপস্থিত ছিলেন।
সিদ্ধান্ত হয় যে, আজ রাতের মধ্যে রাধানগর এলাকায় সকল নকশালের বাড়ী আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হবে। সে মোতাবেক ড্রামভর্তি পেট্রোল জোগাড় করা হয়। বিশু, ইকবাল, করিম, সেলিম, হেলাল, মুকু, ফজলুল হক মন্টু, বেবী ইসলাম, হুমায়ুন, শরিয়ত সহ ১৭/১৮ জন সজ্জিত হয়ে হায়দার ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি থেকে দোনলা বন্দুক, নুরুমিয়ার দোনলা, আমিনুল ইসলাম চৌবে ওরফে বিলু বাবুর দোনলা টুটুবোর, খলিল সাহেবের টুটুবোর সংগ্রহ করা হয়। আলতাব কন্ট্রাক্টরের বাড়িতে গিয়ে তার বন্দুক পাওয়া যায় না তবে এরিুকের ২২ বোরের বন্দুক সহ মোট ১৯টি অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। বন্দুক নেওয়ার খবর থানায় পৌছানোর পর ও,সি আব্দুল ওদুদ তখন আমাদেরকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন। ডি,এস, পিও বন্দুক উদ্ধারের জন্য তখন দারুন ব্যস্ত। বন্দুক নিয়ে নেয়ার খবরে সারা শহরে তোলপাড় শুরু হয়।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় যে আক্রমণ হয় পরদিন সকাল পর্যন্ত সে খবর পাবনাতে পৌছেনা। কিন্তু পাবনা কাশিপুর শিল্প এলাকাতে অবস্থানরত পাক আর্মিরা মাইকিং করে যে, শহর মে কারফুজারি হোগেয়া, কুই আদমি ঘরছে বাহের না নেকালো, নেকালেছে খতম করনা হোগা। শহরের মিট প্লেসে¬ খবর দিয়ে আমরা কয়েকজন রামচন্দ্রপুর চরে চলে যাই শেল্টারের জন্য। সেখানে তোফাজ্জল মালিথা ও নবাব আলী মোল্ল¬া আমাদেরকে আরো ভিতরের দিকে কোমরপুর চরে ছাকা মোল্ল¬ার বাড়িতে নিয়ে যায়, সেখানে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় পাবনার ডি,সি নুরুল কাদের খানও পালিয়ে হিমায়েতপুরের কুটি পাড়ার, মাঝি পাড়া একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। তার সঙ্গে আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুর রব বগা মিয়া ছিলেন। সে জায়গায় ওয়াজি উদ্দিন খান, গোলাম আলী কাদেরীও ছিলেন। আমার বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাক মুকুলের মাধ্যমে খবর পেয়ে বেশ কিছু সঙ্গি সহ রাতে মাঝি পাড়ার ঐ বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। ডি,সি সাহেব বলেন যে পুলিশকে ষ্ট্যান্ড বাই অবস্থায় রাখা হয়েছে। অমুক অমুক যায়গায় অস্ত্র আছে।
এমতাবস্থায় আমাদের এখন কি করতে হবে এমন শলা পরামর্শ করতে করতে রাত প্রায় ভোর হয়। ডি,সি নুরুল কাদের খান সকলের হাতের উপর হাত রেখে শপথ বাক্য পাঠ করালেন। হঠাৎ আকাশ বাতাস ভেদ করে গুলির শব্দ শোনা গেল। অনুমাণ করা গেল পাক আর্মি পুলিশ লাইনে আক্রমণ করেছে। তখন আমরা কাচারিপাড়া মন্ডল পাড়ায় গিয়ে অন্যান্যদের দেখা পাই, সকলে মিলে জামতলা বাঁধে গিয়ে পজেশন নেওয়া হয়। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।