এবাদত আলী
১৯৬৪-৬৫ শিক্ষা বর্ষে পাবনা আরএম একাডেমিতে একটি নাইট কলেজ খোলা হয়। কর্মজীবী মানুষদের লেখাপড়ার বিষয়ে অগ্রণি ভুমিকা পালন করে ‘পাবনা নাইট কলেজ পাবনা’ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন অধ্যক্ষ আব্দুল গণি। অধ্যাপক আবু সাঈদ এবং এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষকগণ এই কলেজে শিক্ষকতা করতেন। পাবনায় এটাই সর্বপ্রথম নৈশ কলেজ।
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধে।
এই যুদ্ধে পুর্ব-পাকিস্তান থেকে যুবকদেরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ট্রেনিং গ্রহণের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়। স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে তাই সিভিল ডিফেন্সসহ যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষনের জন্য আহবান জানানো হয়। এই আহবানে সাড়া দিয়ে নিজের মাতৃভূুমিকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধে যেতে রাজি হয়ে আমি এবং আমার সহপাঠি নজরুল ইসলামসহ অনেকেই নাম লেখাই এবং ট্রেনিংএ অংশগ্রহণ করি।
সেসময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন পাবনা-চাটমোহরের চৌধুরি পরিবারের সন্তান জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী আন্তর্জাতিক সীমানারেখা বরাবর পাঞ্জাব ফ্রন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নেন । কাশ্মির উপত্যকার সঙ্গে স্থলপথে যোগাযেগের মাধ্যমে একে রক্ষা করা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি ছিলো ভারতীয় দৃষ্টিকোন থেকে একটি বিরাট পদক্ষেপ। ভারতীয় সেনাবাহিনী আর্ন্তজাতিক সিমানা রেখা বরাবর একই সঙ্গে দুটি আক্রমণ পরিচালনা করে। প্রথমটি ছিলো ৬ সেপ্টেম্বর লাহোর অভিমুখে এবং অন্যটি ছিলো পরদিন শিয়ালকোট অভিমুখে।
ভারত লাহোর আক্রমণে কিছু প্রাথমিক সাফল্য লাভ করে, কিন্তু ফিরবার পথে সারিবদ্ধ পানিসেচ খালের কারণে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই পানিসেচ খালের উপর নির্মিত প্রায় ৭০টি সেতু বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে পরিখার সৃষ্টি করে। অবশ্য পাকিস্তান ভারত অধিকৃত পাঞ্জাবের খেমকারান নামক একটি ছোট শহরে প্রতিআক্রমণ পরিচালনা করে। পাকিস্তানি সেনারা ১শ২০ থেকে ১শ ৫০ টি ট্যাংক ও অন্যান্য সেনাযানে সজ্জিত সক্রিয় ও শক্তিশালী পাকিস্তানের প্রথম সশস্ত্র বাহিনী এই আক্রমণ পরিচালনা করে।
৬ সেপ্টেম্বর খেমকারান সেক্টর দিয়ে ভারত করাচি আক্রমণ করে বসে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের তখন ত্রাহি অবস্থা। তিনি কখনো ভাবতে পারেননি যে ভারত শ্রীনগর যুদ্ধকে আর্ন্তজাতিক সিমান্তে টেনে নেবে। কিন্তু অকুতোভয় বাঙালি সেনা সদস্যের কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। বাঙালি হাবিলদার তাজুল ইসলাম শরীরে গ্রেনেড বেঁধে নিজের জীবন উৎসর্গ করে
ভারতীয় ট্যাংক ধ্বংস করে দেয়। এই যুদ্ধের ইতিহাসে খেমকারান সেক্টরে বাঙালির অদম্য সাহসের কারণে এবং তাদের প্রচন্ড প্রতিরোধে ভারতীয় সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের ৮টি ডিভিশনের মধ্যে মাত্র ৪টি ব্যাটেলিয়ানের মাধ্যমে সংগঠিত ছিলো। এর অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কঃ আতিক হক। পাকিস্তানি ফাইটার পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার এমএম আলম যিনি ছিলেন একজন বাঙালি। তিনি একাই ৫টি ভারতীয় যুদ্ধ বিমান ভুপাতিত করেন। এই অসম সাহসিকতার জন্য যুদ্ধের পর তাকে সিতারাই জুরাত উপাধিতে ভুষিত করা হয় এবং ঢাকা মিউনিসিপালটি করপোরেশন তাকে ঢাকায় একটি বাড়ি উপহার দেয়।
শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে পাকিস্তান সাফল্য লাভ করে এই অর্থে যে ভারতীয় সেনাবাহিনী শিয়ালকোট অভিমুখে অভিযান বন্ধ করে দেয়। উভয়েই একটি যুদ্ধ বিরতির দিকে নমনীয় হয়ে পড়ে। এরূপ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব ২০ সেপ্টেম্বর অত্যন্ত কঠোর ভাষায় যুদ্ধ বিরতির জন্য সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করলে ২১ সেপ্টেম্ব ভারত এবং পরের দিন পাকিস্তান তা গ্রহণ করে।
এই যুদ্ধ বিরতির চুড়ান্ত ঘোষণার পুর্ব পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই যুদ্ধে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে কতকটা অতিরঞ্জিত দাবির উল্লেখ করে। ১৯৬৫ সালের ১৭ অক্টোবর ওয়াশিংটন পোষ্ট ওয়াশিংটনের এক সামরিক জরিপ উদ্ধৃত করে ঘোষণা দেয় যে, পাকিস্তানের ১১শ ট্যাংকের মধ্যে আনুমানিক ২শ ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং অন্য ১শ৫০টি ট্যাংক বিকল হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ভারতের মোট ১হাজার ৪শ ৫০টি ট্যাংকের মধ্যে ১শ ৭৫ থেকে ১শ ৯০ টি ধ্বংস হয়। সামরিক বিমানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রায় ২০টি বিমান ধ্বংস হয়। অপরদিকে ভারতের বিমান ধ্বংস হয় ৬৫ থেকে ৭০ টির মত। সেনা হতাহতের দিক থেকে পাকিস্তানের সেনা সংখ্যার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৮শ এবং ভারতের ৩ হাজার। অন্য দিকে ভুখন্ডের দিক থেকে পাকিস্তানের ভুখন্ড হারানোর পরিমাণ ৭শ ২০ বর্গ মাইল এবং ভারত হারায় প্রায় ৩শ বর্গ মাইল।
এই যুদ্ধ বিরতির পর সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগে তাশখন্দে একটি শান্তি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য যুদ্ধমান দুটি পক্ষ প্রয়োজনীয় মুল কাজ শেষ করতে প্রায় ৩ মাস সময় নেয়।
অবশেষে ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫, উভয় পক্ষই যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব গ্রহণ করে। উভয় দেশই সিমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মত হয়। ফলে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ এবং বিশেষত এর ফলাফল সম্ভবত আইয়ুব শাসনের শেষ পরিণতির সুচনা করে।
যাক মাতৃভুমি পাকিস্তান রক্ষার জন্য যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি হিসেবে আমাদেরকে ফাষ্ট এইড ট্রেনিং, ব্লাকআউট, ট্রেঞ্চ খনন, বাংকার খনন, বিমান হামলায় করনিয়, জনগণকে সতর্কিকরণসহ রাইফেল ট্রেনিং পর্যন্ত দেওয়া হতে থাকে। পাবনা সদর হাসপাতালের ডাক্তার, সিভিল ডিফেন্স অফিসার, পুলিশ অফিসার, সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ আমাদেরকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিতেন। এই প্রশিক্ষণ শেষে আমাদেরকে হায়ার ট্রেনিংএর জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। আর সেই ট্রেনিং হবে ক্যান্টনমেন্টে। ভবিষ্যতে এই ট্রেনিংএর মাধ্যমে ইচ্ছা করলে তাদেরকে সেনাবাহিনীতে রিক্রুট করা হবে বলেও জানানো হয়। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হয়না। ট্রেনিং চলাকালিন সময়েই যুদ্ধ থেমে যায়। আমাদেরকে ট্রেনিং কোর্স সম্পাদনের জন্য সার্টিফিকেট প্রদান করা হয় এবং দেশের ক্রান্তিলগ্নে সাহসিকতাপুর্ণ কাজের মুল্যায়ন হিসেবে আর এম একাডেমির অস্থায়ী হল রুমে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদেরকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।