আজ ১৪ মার্চ। আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। নদীর প্রতি দায়বদ্ধতা মনে করিয়ে দিতে ১৯৯৭ সালে ব্রাজিলের কুরিতিবা শহরে এক সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয়। তাইওয়ান, ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, থাইল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের অংশ গ্রহনে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে নদী বাঁচাতে প্রতি বছর ১৪ মার্চ নদীকৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমান সময়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), জাতীয় নদী রক্ষা আন্দোলনসহ পঁচিশের অধিক সংগঠন যৌথভাবে নাগরিক সমাবেশের আয়োজন করে। প্রসঙ্গত ঃ অপরিকল্পিত বাঁধ, স্লুইজগেট, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণের ফলে এবং দখল দূষণে চলনবিল এলাকার ২৫ নদ-নদী ভূগছে নাব্যতা সংকটে।
মাঘ ফাল্গুনেই শুকিয়ে যাচ্ছে চলনবিল এলাকার নদ-নদী গুলো। বছরের পর বছর খনন না করায় এ এলাকার নদ নদী গুলো ভূগছে নব্যতা সংকটে। ফলে সেচ কার্য ব্যহত হবার পাশাপাশি দেশী মৎস সম্পদ ও আজ বিলুপ্তির পথে। এর প্রভাব পরছে ব্যবসা বানিজ্যে ও। চলনবিল এলাকার নদী নালা হারিয়েছে পূর্ব জৌলুশ ও স্বকীয়তা। মাঘের শুরুতে এসেই অধিকাংশ নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে সে সকল নৌরুটের নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা। জল পথে পণ্য পরিবহনে খরচ কম হলেও বর্তমান সময়ে এ এলাকার সব জলপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অধিক খরচে ব্যবসায়ীদের স্থল পথে পণ্য পরিবহন করতে হচ্ছে।
অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থ সূত্রে এবং চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমানের সাথে কথা বলে জানা যায়, জলপাইগুড়ির পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া আত্রাই নদী রাজশাহীতে এসে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পরে। এর একটি শাখা কয়রাবাড়ি, নন্দনালী ও নওগা জেলার আত্রাই উপজেলা হয়ে আত্রাই ঘাটের এক মাইল নি¤œ হতে “আত্রাই” ও “গুড়” নামে দুই ভাগ হয়ে যায়। গুড় নদী নাটোরের সিংড়া পর্যন্ত চলে আসে। অপরদিকে আত্রাই নদী একান্ন বিঘা,যোগেন্দ্রনগর ও কালাকান্দরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় বাঁশের বাজার এলাকায় এসে বড়াল নদের শাখা নন্দ কুজার সাথে মিশেছে। এদের মিলিত ¯্রােত গুমানী নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বওশা এলাকার ভাটিতে গিয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পরে। একটি ভাগ অষ্টমনিষা হয়ে ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা নামক স্থানে বড়ালে মিশেছে। গুমানী নদীর অপর ভাগ নূরনগরে বড়াল নদীর সাথে মিশেছে। ১৭৮৭ সালে তিস্তার সাথে আত্রাই নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। জলপাইগুড়ির উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ নিমগাছী তাড়াশ, চাটমোহরের হান্ডিয়াল হয়ে অষ্টমনিষার কাছে গুমানী নদীতে মিশেছে। ১৩০৪ সালে ভূমিকম্পে নদীটির কয়েক যায়গা মরে যায়। বগুড়া শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ভিতর দিয়ে বাঘাবাড়ি ব্রীজের এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে এসে করতোয়া বড়াল পয়েন্টে হুরাসাগরের সাথে মিশেছে। রায়গঞ্জের নিম্নাংশ থেকে এটি ফুলজোড় বা বাঙালী নদী নামেও পরিচিত। রাজশাহীর চারঘাট থেকে পদ্মার অন্যতম প্রধান শাখা নদ বড়াল রাজশাহীর বাঘা, নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম হয়ে চাটমোহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে গুমানীর সাথে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া ফরিদপুর বাঘাবাড়ি হয়ে হুরাসাগরের সাথে মিশে নাকালিয়া এলাকায় গিয়ে যমুনার সাথে মিশেছে।
১৯৮৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত বড়াল নদটি স্রোতস্বীনি থাকলেও ১৯৮৫ পরবর্তী সময়ে রাজশাহী থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদীটির অনেক স্থানে ¯øুইজগেট ও ক্রস বাধ দেয়ায় এ নদীটি এখন মৃতাবস্থায় পরে আছে। ২০০৮ সাল থেকে এ নদী উদ্ধারে বড়াল রক্ষা আন্দোলন ও চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তরা দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করে আসার ফলশ্রæতিতে চাটমোহর নতুন বাজার, বোঁথর ঘাট ও রামনগরের ঘাটের তিনটি ক্রসবাঁধ অপসারণ করা হলেও এখন ও পদ্মার সাথে যমুনার সংযোগ ঘটানো সম্ভব হয় নি। আশার কথা চারঘাট ¯øুইজগেট থেকে ১ হাজার ৮শ মিটার এলাকা খনন করে পদ্মার সাথে সংযোগ করা হয়েছে। কিন্তু চারঘাটে ¯øুইজগেট থাকায় এবং ২শ ২০ কিলোমিটার বড়ালের অধিকাংশ স্থান দখলদারদের কবলে থাকায় এবং ব্যাপক দূষণের ফলে নদীটি মৃতপ্রায় অবস্থায় উপনীত হয়েছে। চাটমোহরের ক্রসবাঁধগুলো অপসারণের ফলে বর্তমান সময়ে চাটমোহর থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত বর্ষায় কিছুদিনের জন্য প্রাণ ফিরে পায় নদটি। চেঁচুয়া নদী ধারাবারিষার দক্ষিণপাশ দিয়ে চতরার বিল, জোড়দহ, আফরার বিল, খলিশাগাড়ি বিল ও কিনু সরকারের ধর হয়ে চরসেনগ্রামের পশ্চিমে গুমানী নদীর সাথে মিশেছে। এ নদীটি ও অস্তিত্বহীন হয়ে পরেছে।
দক্ষিণ চলনবিলের বড়াইগ্রামের চিনাডাঙ্গা বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাটমোহরের মূলগ্রাম ফৈলজানা হয়ে ফরিদপুরের ডেমরার কাছে চিকনাই নদী বড়াল নদীতে মিশেছে। ডেমরা এলাকায় ¯øুইজগেট থাকায় ফরিদপুর থেকে নদীটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে মাস চারেক এ নদীতে পানি থাকলেও বাকী ৮ মাস পানি শূণ্য থাকে নদীটি। দখল দূষণের ফলে বানগঙ্গা, তুলশী নদী, ভাদাই নদী, মরা আত্রাই নদীসহ চলনবিলের ২৫ নদীর বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত করুন।
নদী শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা যমুন নদী হয়ে ঢাকা থেকে যে সকল পণ্য নৌপথে আনতেন এখন তা পারছেন না। সড়ক পথে পণ্য পরিবহনে তাদের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। ক্রেতারা ও বিভিন্ন হাট বাজার থেকে পণ্য কিনে নৌপথে বাড়িতে নিতে পারছেন না। নদী গুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পরেছে হাজার হাজার মৎস জীবি। পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন তারা। পূর্বে নদী থেকে কৃষক অগভীর নলকূপের সাহায্যে বোরো ক্ষেতে পানি সেচ দিতে পারলেও এখন তা পারছেন না। উপরন্ত পানির স্তর দ্রæত নীচে নেমে যাওয়ায় অগভীর পাম্প মালিকরা মৌসুমের শুরুতেই তাদের সেচ পাম্প সমতল থেকে অন্তত ১০ ফিট নিচে স্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। আত্রাই রিভার ড্রেজিং কাজ শুরু হলেও সেখানে অনিয়মের প্রশ্ন ওঠে শুরু থেকেই। যেখানে বালি পাওয়া সম্ভব এমন কিছু এলাকা খনন করে সংশ্লিষ্টদের অর্থের বিনিময়ে বালি বিক্রি করতে দেখা যায়।
পরিবেশ বিদ ডঃ এস এম মুক্তিমাহমুদ জানান, ভৌগলিক ভাবে এ এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো নদীর জীবন চক্রের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ বার্ধক্য অবস্থায় পরিণত হয়েছে। লক্ষণীয় যে, চলনবিল এলাকার নদীর তলদেশের ঢালের পরিমান কম, নদীর প্রবাহমান পানির পরিমান কম, ¯্রােতের বেগ ও কম। উৎসস্থান থেকে নদীগুলোর দূরত্ব অধিক হওয়ায়, পানির সংগে প্রবাহিত মৃত্তিকা কনা বালুকনা, নূড়িকনা এবং অন্যান্য ময়লা আবর্জনার পরিমান বেশি ও নদীর তলদেশে তা সঞ্চয়নের পরিমান ও অধিক হওয়ায় ক্রমশই নদী উপত্যকার পানি ধারণ ক্ষমতা কমে আসছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদী গুলো একেবারেই শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের খাদ্য শৃঙ্খল ব্যহত হচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপন ও ফসল উৎপাদনসহ পানি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সকল কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। ফলে বিপর্যয় ঘটছে সার্বিক পরিবেশেরও।
চলনবিল রক্ষা আন্দোলন ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান আরো জানান, নদ নদী খাল বিল চলনবিলের প্রাণ। অপরিকল্পিত বাঁধ, ¯øুইজগেট, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণ এবং দখল দূষণের ফলে চলনবিল এলাকার ২৫ নদ-নদী করুণ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বেশির ভাগ নদী আজ অস্তিত্ব সংকটে পরেছে। এগুলো রক্ষা করতে না পারলে চলনবিল তার স্বকীয়তা হারাবেই। আমরা দীর্ঘদিন যাবত এ এলাকার নদ নদী রক্ষায় আন্দোলন করে আসছি। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করলে তবেই বাংলাদেশের বৃহত বিল, ঐতিহ্য বাহী চলনবিল এবং এর অন্তর্ভূক্ত ২৫ নদী প্রাণ ফিরে পাবে।