বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম উত্তরা গণভবন। এটি নাটোর শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি এককালের দিঘাপতিয়া মহারাজাদের বাসস্থান। বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম উত্তরা গণভবন। এটি নাটোর শহর থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি এককালের দিঘাপতিয়া মহারাজাদের বাসস্থান। নাটোরের উত্তরা গণভবন প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন। প্রায় তিন শবছরের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের সৌন্দর্যমণ্ডিত এ ভবন আজো কালের সাী হয়ে উত্তরা গণভবন নামে দেশব্যাপী এক নামে পরিচিত। এখানে একসময়ে শোনা যেত নূপুরের ঝঙ্কার, সঙ্গে সুরের মূর্ছনা। ছিল পাইক-পেয়াদায় কর্মচাঞ্চল্য, রাজ-রাজন্যবর্গের গুরুগম্ভীর অবস্থান, আরো ছিল বিত্তবৈভবের ঝলক। কিন্তু এখন আর এসব নেই। কালের সাী (দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি) বর্তমানে উত্তরা গণভবন নাম নিয়ে আজো স্মৃতি বহন করে চলেছে। ভবনটির সামনে এলে সবাইকে থমকে যেতে হয়। দৃষ্টিনন্দন সুদৃশ্য বিশাল সিংহদুয়ার বা ফটক। এর ওপরে স্থাপিত প্রকাণ্ড এক ঘড়ি, যা ঘণ্টা বাজিয়ে আজো এলাকার মানুষকে সঠিক সময় জানান দিয়ে যাচ্ছে। উত্তরা গণভবনে প্রবেশের এটিই একমাত্র পথ। চার দিকে সুউচ্চ প্রাচীর ও পরিখার বেষ্টনী, দেশী-বিদেশী দু®পাপ্য অনেক বৃরাজি, ইতালিয়ান গার্ডেনের শ্বেতপাথরের ভাস্কর্যশোভিত দৃষ্টিনন্দন বিশাল এ রাজপ্রাসাদ।
প্রতিষ্ঠা : দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। ১৭১০-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই রাজবংশের রাজা দয়ারাম রায়, জগন্নাথ রায়, প্রাণনাথ রায়, প্রসন্ননাথ রায়, প্রমথনাথ রায়, প্রমদানাথ রায়, প্রতিভানাথ রায়, অষ্টম ও বংশের শেষ রাজা প্রভাতনাথ কুমার কৃতিত্বের সঙ্গে রাজ্য শাসন করে ইতিহাসের পাতায় এখনো অমর হয়ে রয়েছেন। জেলা সদর থেকে প্রায় পৌনে দুই কিলোমিটার উত্তরে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে রাজা দয়ারাম রায় দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাচীরের বাইরের ফটকের সামনে রয়েছে ২.৮৯ একর জমি। রাজা প্রমদানাথ রায়ের সময় ১৮৯৭ সালে ১০ থেকে ১২ জুন তিন দিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে শুরু হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে যোগ দেন। কিন্তু অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন ১৮ মিনিটব্যাপী প্রলয়ঙ্করী ভ‚মিক¤েপ রাজপ্রাসাদ ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হয়। এ প্রাসাদ ধ্বংস হলে ১৮৯৭-১৯০৮ সাল পর্যন্ত সময়ে বিদেশী প্রকৌশলী চিত্রকর্ম বিশেষজ্ঞ শিল্পীদের সহায়তায় ৪১.৫০ একর জমির ওপর এ রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায় রাজবাড়িটি পুনর্নির্মাণ করেন।
চার দিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে পরিবেষ্টিত স্থানে বিশেষ কারুকাজখচিত মূল ভবনসহ ছোট-বড় মোট ১২টি ভবন নির্মাণ করেন ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ। মুঘল ও প্রাশ্চাত্য রীতি অনুসারে নান্দনিক
কারুকার্যময় প্রাসাদটিকে এক বিরল রাজভবন হিসেবে গড়ে তোলেন।
যা আছে : দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার ছাড়াও এখানে রয়েছে মোট ১২টি ভবন। এগুলো হচ্ছে প্রধান প্রাসাদ ভবন, কুমার প্যালেস, প্রধান কাচারিভবন, তিনটি কর্তারানী বাড়ি, রান্নাঘর, মোটর গ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার, ট্রেজারি বিল্ডিং ও সেন্ট্রি বক্স। প্যালেসের দেণ রয়েছে ফুলের বাগান। এ বাগানটি ইতালিয়ান গার্ডেন নামে পরিচিত। দেশী-বিদেশী নানা জাতের ফুলে পরিপূর্ণ এ বাগান। বাগানের ভেতর শ্বেতপাথরের আকর্ষণীয় চারটি নারীর ভাস্কর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। রয়েছে একটি ইতালিয়ান টাইপের ফোয়ারা এবং মাঝে মধ্যে লোহা ও কাঠ দিয়ে নির্মিত বেঞ্চ, একটি ডিম্বাকার মার্বেল পাথরের নির্মিত আসনসহ প্লাটফর্ম। সারা বাগান শুধু ফুল আর ফুলের সমারোহ। আছে নাগালিঙ্গম, কর্প‚র, এগপ্লান্ট, হৈমন্তীর মতো দু®প্রাপ্য সব বৃক্ষরাজি আর কৃত্রিম ঝরনা।
রাজ ভবন : দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির মূল প্রাসাদটি একতলা। এর মাঝে রয়েছে প্রশস্ত একটি হলরুম। বেশ উঁচু হলরুমের শীর্ষে রয়েছে বিশাল এক গম্বুজ। এ গম্বুজের নিচ দিয়ে হলরুমে আলো-বাতাস প্রবেশ করে। হলরুমের মাঝে রাজার আমলে তৈরি বেশ কিছু সোফা রয়েছে। এ ছাড়া হলরুমে একটি কারুকাজখচিত সোফা রয়েছে, যাতে একসঙ্গে চারজন চারমুখী হয়ে বসা যায়, যা বিরল। উত্তরা গণভবনে মন্ত্রী পরিষদ সভাসহ উচ্চপর্যায়ের কোনো সভা হলে এ রুমেই হয়। হলরুমের আসবাবপত্র এখনো রয়েছে। ওপরে রয়েছে সে আমলের ঝাড়বাতি। হলরুমের পাশে রয়েছে আরেকটি বড় ঘর। পাশের রান্নাঘর থেকে এ ঘরে সরাসরি আসা যায়। নিরাপত্তার জন্য রান্নাঘরের করিডোরের দুই পাশে রাজ আমলের তার দিয়ে এখনো ঘেরা রয়েছে। এর পাশে একটি ঘরে রয়েছে সিংহাসন। এর পাশের ঘরটি ছিল রাজার শয়নঘর। এ ঘরে এখনো রাজার খাট শোভা পাচ্ছে। শোবার ঘরের বারান্দার চার দিকে তার দিয়ে ঘেরা ছিল। কুমার ভবনের পেছনের ভবন রাজার কোষাগার আর অস্ত্রাগার। ছিল রানীমহল। আজ আর সেটা নেই। ’৬৭ সালে ভেঙে ফেলা হয়েছে। রানীমহলের সামনে একটি ফোয়ারা এখনো সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। তারই পাশে ছিল দাসী ভবন। রাজার একটি চিড়িয়াখানাও ছিল। নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন আবার নতুন করে সেই চিড়িয়াখানা চালু করেছেন। শাহিনা খাতুনের উদ্যোগে রাজার ট্রেজারি ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে সংগ্রহশালা। রাজা-রানীর ব্যবহৃত নানা সামগ্রী সংগ্রহ করে দর্শনার্থীদের দেখার জন্য এ সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছে। মূল ভবন রাজপ্রাসাদের সামনে রয়েছে রাজা প্রসন্ননাথ রায় বাহাদুরের আব মূর্তি। এর দুই পাশে রয়েছে ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশদের স্থাপন করা দু’টি কামান। মূল প্যালেসের মাঠের পূর্বে রয়েছে
রাজার দোলমঞ্চ। পাশেই রয়েছে কুমার প্যালেস। এর সামনে বসানো চার চাকাবিশিষ্ট একটি কালো কামান আজো শোভা পাচ্ছে। মূল রাজপ্রাসাদের প্রবেশের পথে সিঁড়ির দুই পাশে ছিল দু’টি কালো কৃষ্ণমূর্তি, যা এখন শোভাবর্ধন করছে সংগ্রহশালার। প্রাসাদের প্রবেশ করিডোরে রয়েছে ধাতব বর্ম। এটি পরই নাকি রাজা যুদ্ধে যেতেন। এ কারণে পিতলের তৈরি এ বর্মটি দর্শনার্থীদের আরো বিশেষভাবে নজর কাড়ে। রাজপ্রাসাদের উত্তর পাশে ছিল রাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অষ্টাদশ শতকের রাজবাড়ি বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করত। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সেসব সরঞ্জাম আজো কেন্দ্রস্থলে পড়ে রয়েছে। পুরো রাজপ্রাসাদে ছিল রাজার বিভিন্ন চিত্রকর্ম, ছবি আর বিদেশী ঘড়িÑ আজ সেসব নেই। প্রাসাদের শ্বেতপাথরের মেঝে মোড়ানো থাকত পার্শিয়ান গালিচায়। রাজা প্রমদানাথ রায়ের প্রচণ্ড রকম ঘড়িপ্রীতি ছিল। এ জন্য তিনি দেশ-বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে ঘড়ি তৈরি করে আনতেন। এসব ঘড়ি মূল প্রাসাদ ভবন ছাড়াও বিভিন্ন ভবনে স্থাপন করতেন। এমন একটি ঘড়ি ছিল, যাতে ১৫ মিনিট পরপর জলতরঙ্গ বাজত। এ ছাড়া রাজবাড়ির মূল ফটকে রয়েছে একটি ঘড়ি। এর দুই পাশে দু’টি ডায়াল। ঘড়িটি এখনো সঠিকভাবেই সময় দিচ্ছে। ঘড়িটি নাকি ইতালির ফোরেন্স থেকে আনা হয়েছিল। আগে এর ঘণ্টাধ্বনি ১০-১২ মাইল দূর থেকে শোনা যেত, এখন এ ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায় এক মাইল দূর থেকে। শোনা যায় স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়দঘাপতিয়া রাজবাড়িতে পাকবাহিনীর ক্যা¤প হওয়ায় কিছু ঘড়িসহ অন্যান্য মূল্যবান স¤পদ ওরা নিয়ে
যায়।১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা দেশত্যাগ করে চলে যান। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাজবাড়িটি অধিগ্রহণ করে। ১৯৬৭ সালে এটি তৎকালীন গভর্নর হাউসে রূপান্তরিত হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি ১৯৭২ সালে এই ভবনের মূল প্রাসাদের ভেতর মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন। তখন থেকে প্রায় সাড়ে ৪১ একর জায়গাজুড়ে পরিখা ও উঁচু প্রাচীরে ঘেরা ভবনটি উত্তরা গণভবনের’ প্রকৃত মর্যাদা লাভ করে।
উত্তরা গণভবন সংগ্রহশালা : সংগ্রহশালাটি ২০১৮ সালের ৯ মার্চ স্থাপিত হয়। উত্তরা গণভবনের
পুরাতন ট্রেজারিভবনে স্থাপিত সংগ্রহশালায় বিভিন্ন রাজার আমলের অন্তত শতাধিক জিনিসপত্র স্থান পেয়েছে। এই সংগ্রহশালাকে রাজার আমলের শতাধিক দু®প্রাপ্য সামগ্রীর সমাহারে সাজানো হয়েছে। অতীতের সাথে বর্তমানের মেলবন্ধন তৈরি করেছে এই সংগ্রহশালা।
সংগ্রহশালার করিডোরে রাজা প্রমদানাথ রায় ও সস্ত্রীক রাজা দয়ারাম রায়ের ছবি আর রাজবাড়ির
সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে। করিডোরে মার্বেল পাথরের একটি রাজকীয় বাথটাব প্রদর্শন করা হয়েছে। ডানপাশের কক্ষে রাজার পালঙ্ক, ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টেবিল, আরামচেয়ার আর ড্রেসিংটেবিল স্থাপন করে তৈরি করা হয়েছে রাজার শয়নকক্ষ।
বামপাশের দ্বিতীয় কক্ষে শোভা বাড়াচ্ছে রাজসিংহাসন, রাজার মুকুট আর রাজার গাউন। আরও
আছে মার্বেল পাথরের থালা, বাটি, কাচের জার, পিতলের গোলাপ জলদানি, চিনামাটির ডিনার সেট।
এই কক্ষে লেখক গবেষকরা অনায়াসে লেখার উপাদান পেয়ে যাবেন রাজপরিবারের লাইব্রেরির বই আর শেষরাজা প্রতিভানাথ রায়ের ইন্সুরেন্সবিষয়ক কাগজপত্রের মধ্যে।
একটি কক্ষ রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা চৌধুরাণীর। সুলেখক ইন্দ্রপ্রভাকে রাখা হয়েছে তারই পিতলের ছবির ফ্রেমে। আছে তার ব্যক্তিগত ডায়েরি, আÍজীবনী, পাণ্ডুলিপি ও তার কাছে লেখা স্বামী মহেন্দ্রনাথ চৌধুরীর রাশি রাশি চিঠি।
দর্শনার্থীদের জন্যে ইন্দুপ্রভার লেখা বঙ্গোপসাগর কবিতাটি ফ্রেমে বাঁধাই করে দেয়ালে টানানো হয়েছে। ৬৭ লাইনের এই কবিতায় মুগ্ধ কবি বর্ণনা করেছেন বঙ্গোপসাগরের অপরুপ সৌন্দর্য।
করিডোর ছাড়াও সংগ্রহশালার দশটি কক্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন সব আসবাবপত্র। বিশেষ করে রকমারি সব টেবিল। এরমধ্যে ডিম্বাকৃতির টেবিল, গোলাকার টেবিল, দোতলা টেবিল, প্রসাধনীটেবিল, অষ্টভুজ টেবিল, চর্তুভ‚জ টেবিল, কর্নার টেবিল, গার্ডেন ফ্যান কাম টি-টেবিল ইত্যাদি।
এদিকে উত্তরা গণভবনের শৈল্পিক নিদর্শন ও সৌন্দর্য দেখতে এলে দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের জেলা প্রশাসনের পূর্বানুমতি নিতে হতো। এই অনুমতি না পেয়ে অনেককেই অভিমানে আর ক্ষোভে নাটোর ত্যাগ করতে হতো। এ নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর নাটোর জেলা প্রশাসন ও পিডবিøউডি’র মাধ্যমে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয় যে, উত্তরা গণভবন দর্শনার্থীদের জন্য টিকিটের মাধ্যমেউন্মুক্ত করা হলে একদিকে যেমন দর্শনার্থীরা এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন, পাশাপাশি এর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। এ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা শেষে ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর গণভবনকে টিকিটের মাধ্যমে উন্মুক্ত করা হয়। বর্তমানে গণভবনের ৮০ ভাগ স্থান ২০ টাকা দর্শনীর বিনিময়ে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।