মেনু

ইঁদারার আত্মকথা

// হারুন অর রশীদ
আমি চুন-সুরকির তৈরির এক ইঁদারা। কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও দাড়িয়ে আছি পাবনার চাটমোহরের ছাইকোলা গ্রামের জেবনার ফিল্ডের পাশে। কবে কিভাবে আমার জন্ম হয়েছিল, তার সঠিক ইতিহাস তোমরা এখনকার কেউ বলতে পারবে না।
আধুনিক যুগে আমি অপ্রয়োজনীয়, অবহেলিত। তোমরা যখন আমার পাশ দিয়ে যাও তখন আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন মোচর দিয়ে ওঠে। একটা চাপা ব্যাথা মনের মধ্যে গুমরে গুমরে আমার অতিত জৌলুশের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পাই তোমাদের পদধ্বনি। তোমরা ফিরেও তাকাও না আমার দিকে। আমার মান অভিমান বাড়ে। কষ্ট বুকে চেপে ভাবি “তোমরা এতো নির্মম, অকৃতজ্ঞ কেন?
শুধুই কি অকৃতজ্ঞতা। তোমরা কৃতঘ্নও বটে। কারণ গত ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর যাবৎ আঘাতে আঘাতে আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করছো। আমাকে এভাবে
ফেলে দিতে পারলে তোমরা ? অথচ একদিন আমাকে কেন্দ্র করেই এখানে বসতো শিশু,কিশোর,যুবক,আবাল, বৃদ্ধা বনিতাদের গল্পের হাট।
আমাকে দেখার কৌতূহল ছিল সবচেয়ে বেশি বাচ্চাদের, তারা উঁকি দিয়ে আমাকে দেখতো, সুযোগ পেলে আবার ঢিল, থুথু নিক্ষেপ করে আমার গভীরতা নির্ণয় করার চেষ্টা করতো এজন্য তারা ধমকও খেতো তাদের মায়ের কাছে।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোমাদের হাঁড়ি পাতিলের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতাম আমি। আমাকে অপবিত্র, অপরিষ্কার করে চলে যেতে তোমরা। আমি
আবারও পবিত্র হতাম। যত কষ্টই পেতাম, এতে আমি কিছুই মনে করতামনা।

কারণ তোমরা যে আমাকে যত্নও কম করতেনা। তোমাদের যত্ন পেলে আমি সব ব্যাথাই ভুলে যেতাম, আমি আবারও সজীব হয়ে উঠতাম।
কতো কথা, কতো হাঁসি-কান্নার স্বাক্ষী যে আমি এর খবর এখন আর কেউ রাখেনা। পাড়ায় নতুন বিয়ে হলে, কেউ জন্ম নিলে, কেউ মারা গেলে আলোচনা হতো আমার কাছে এসে। আনন্দ বেদনার গল্প হতো আমাকে স্বাক্ষী রেখে।

জানতাম নতুন বউয়েরা কিভাবে শাশুড়ি’র দ্বারা নির্যাতিতা হতো, আবার শাশুড়ী কিভাবে কষ্ট পেতেন বউমার কাছে। আমিও বোবা মায়ের মতো তাদের কথা নিরবে শুনতাম, বুঝতাম কিন্তু কিছুই বলতে পারতাম না। বলতে না পারলেও মায়ের মতো তাদের সেবা ঠিকই দিয়ে যেতাম।
তোমাদের আনন্দ বেদনার কথা শুনতে শুনতে কখনো হাসতাম আবার কখনো মনের অজান্তেই চোখ ভিজে যেতো।
আমার বুকের দুগ্ধ পান না করলে এ পাড়াতে কারো বুক শীতল হতোনা।

বাড়িতে মেহমান আসলেই ছুটে আসতো আমার কাছে। চৈত্র-বৈশাখে আমার কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। আমাকে কেন্দ্র করেই আমার আশেপাশে গাছের তলায় বসার জায়গা তৈরী হতো। ক্লান্ত পথিক, তৃষ্ণার্ত রাখালেরা আসতো আমার কাছে, তাদের আমি সেবা দিতাম। আমার বুকের নির্যাস পান করে তৃপ্তির নিশ্বাস নিতো তারা। আমার খুব ভালো লাগতো তখন।

এখনো অনেক বয়স্ক পথিক আমার গাঘেঁষে যাবার সময় আমার প্রশংসা করে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আমার দিকে তাকিয়ে বলে-“কতদিন পড়ে তোমাকে দেখলাম”-কথাগুলো শুনে আমার খুব ভালো লাগে। তখন মনে হয় আবার যদি সেই দিন গুলো ফিরে পেতাম।
এবার বলি অন্য কথা। তোমাদের কাছে আমার কিছু ঋণও আছে। ঋণগুলো আমি শোধ করতে চাই। এজন্য মাঝে মধ্যেই অনেকটা ভাবাতুর হয়ে পরি। এই অপরাধবোধটা আমার হৃদপিণ্ডটাকে কুড়ে-কুড়ে বিক্ষত করে দেয়। পাড়ার

বউ-ঝিঁয়েরা পানি নিতে এসে সোনার-রুপার গহনাগাঁটি আমার কাছে তাদের অজান্তেই গচ্ছিত রেখে গেছেন। এজন্য অনেক সংসারেই মাঝে মধ্যেই কলহ বিবাদ অশান্তি সৃষ্টি হতো। তখন আমার খুব খারাপ লাগতো। হারানো ওগুলো এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। সবসময়ই ভাবি-ওগুলো কিভাবে তোমাদের ফেরত দিয়ে, আমি ঋণ মুক্ত হবো।

যাক, তোমাদের কাছে আমার চাওয়া পাওয়ার আর কিছু নাই। আমি তো এখনো দাঁড়িয়ে আছি। অনেক ইঁদাড়া তোমরা ভেঙ্গে ফেলেছ। একটু জাযগা দখল করে ছিল বলে। দু চারটে ইঁদাড়া এখনো ভগ্নাবশেষ হয়ে রয়ে গেছে তোমার তোমাদের বাড়ির আশে পাশে। তোমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে অবহেলায় অনাদরে পরে আছে। ওগুলো একটু সংরক্ষণ কর। পরবর্তি প্রজন্ম আমাদের জানতে পারবে। আমাদের পরিচিতি টুকু অন্তত থাকবে। এতে উপকার না হলেও অন্ততঃ ক্ষতি হবেনা তোমাদের।
ইতি
পাবনার চাটমোহরের ছাইকোলা পূর্ব পাড়া জেবনার মাঠের পাশের ইঁদারা।