হঠাৎ কেন পারমাণবিক অস্ত্র নীতিতে পরিবর্তন আনলেন পুতিন

রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নীতিমালায় পরিবর্তন আনার কথা জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

গত বুধবার দেশের পরমাণু কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন পুতিন। সেখানে তিনি বলেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো পরমাণু শক্তিহীন দেশ আক্রমণ চালালে তা একরকম। কিন্তু সেই দেশ যদি পরমাণু শক্তিধর অন্য দেশ বা একাধিক দেশের থেকে সাহায্য পায়, তাহলে রাশিয়া বিষয়টিকে যৌথ আক্রমণ হিসেবে ধরে নেবে। এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুতিনের এই পদক্ষেপকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি হিসেবে দেখছেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া তারা প্রশ্ন তুলছেন দেশটির কাছে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা নিয়েও?

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, সোভিয়েত আমলের পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার কাছে রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশটির কাছে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র বা ওয়ারহেড। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের (এফএএস) তথ্য অনুযায়ী, পুতিন নিয়ন্ত্রণ করেন ৫ হাজার ৫৮০টি পারমাণবিক অস্ত্র।

এফএএস বলছে, পুতিনের কাছে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের মধ্যে ১ হাজার ২০০টি পুরোনো। কিন্তু সেগুলো এখন অক্ষত। এছাড়া ৪ হাজার ৩৮০টি কার্যকর পারমাণবিক অস্ত্র তিনি সংরক্ষণ করে রেখেছেন। সংরক্ষণ করে রাখা পারমাণবিক অস্ত্রের মধ্যে ১ হাজার ৭১০টি কৌশলগত অস্ত্র তিনি মোতায়েন করে রেখেছেন। এর মধ্যে ৮৭০টি ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ৬৪০টি সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ২০০টির মতো ভারী বোমারু বিমানঘাঁটিতে রাখা হয়েছে।

রাশিয়ার কাছে এত পারমাণবিক অস্ত্র থাকার অর্থ, রাশিয়া চাইলে পুরো বিশ্বকে কয়েকবার ধ্বংস করতে পারে। রাশিয়ার মতোই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রে পুরো পৃথিবী কয়েকবার ধ্বংস করা সম্ভব। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ৪০ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র ছিল, যা ছিল সর্বোচ্চ। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিল ৩০ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র।

রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন আলোচনায় রয়েছে। সেটি হচ্ছে কোন পরিস্থিতিতে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে? এর উত্তর রয়েছে রাশিয়ার নীতির মধ্যেই। রাশিয়া ২০২০ সালে তাদের পারমাণবিক নীতিমালা ঠিক করে। কোন পরিস্থিতিতে রুশ প্রেসিডেন্ট পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেবেন, তা ওই সময় ঠিক করা হয়। তাতে বলা হয়, ব্যাপক পারমাণবিক বা গণবিধ্বংসী অস্ত্রের হামলার মুখে পড়ে জবাব দিতে অথবা রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রচলিত অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে যখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যাবে, তখন রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে।

এর মধ্যেই আজ বৃহস্পতিবার পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নীতিমালায় পরিবর্তনের কথা বলেছেন। তার এ পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার প্রতি হুমকি বেড়ে গেলে যা রাশিয়ার পক্ষ থেকে হামলা বলে বিবেচনা করা হবে, সে ক্ষেত্রেও জবাব দিতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে রাশিয়া। এছাড়া মিত্র বেলারুশকেও তিনি পারমাণবিক সুরক্ষার ছায়ায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ ছাড়া তার ধারণার মধ্যে রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ রাশিয়ার ওপর হামলাকে সমর্থন দিলেও তিনি তাকে আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করবেন। পুতিনের এই মতামত এখনো নীতি আকারে প্রকাশ করা হয়নি। এগুলো প্রকাশ করা হবে কি না, তা–ও এখনো পরিষ্কার নয়।

রাশিয়াকে ঘিরে আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে দেশটি কি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র আরও বাড়াবে? যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে তাদের পর্যালোচনায় বলেছিল, রাশিয়া ও চীন তাদের পারমাণবিক শক্তি সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণ করছে। ওয়াশিংটন ব্যয়বহুল অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ওপর ভিত্তি করে একটি পদ্ধতি অনুসরণ করবে।

এফএএসের পক্ষ থেকে রুশ সেনাবাহিনী নিয়ে ২০২৪ সালের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, রাশিয়ার পারমাণবিক বিবৃতি এবং হুমকিমূলক বক্তব্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। তবে চলমান আধুনিকীকরণের বিষয়টির বাইরে ২০২৩ সালে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রাগার এবং কার্যক্রম ঘিরে আমাদের যে পর্যবেক্ষণ ছিল, তা সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। রুশ কৌশলগত সেনাবাহিনীর কাছে যত সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল তা ভবিষ্যতে বেড়ে যেতে পারে।

কারণ, একটি অস্ত্রযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্রের পরিবর্তে একাধিক অস্ত্রযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে। রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের মোতায়েন ঘিরে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে কী ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট নয়।

পুতিনের হুমকি ঘিরে আরেকটি প্রশ্ন উঠছে আর তা হচ্ছে রাশিয়া কি পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে? পুতিন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি পরীক্ষা চালায়, তবে রাশিয়াও পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর বিষয়টি বিবেচনা করবে। এ মাসেই পুতিনের এ অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে রয়টার্স।

এছাড়া গত বছর পুতিনের ইচ্ছা অনুযায়ী দ্রুত একটি পদক্ষেপ নেয় দেশটির পার্লামেন্ট। পশ্চিমের সঙ্গে তীব্র উত্তেজনা চলার সময় পারমাণবিক পরীক্ষার ব্যাপারে মস্কোর আইনি অবস্থান পরিবর্তন করে, এমন একটি বিল পাস করেছে তারা। রাশিয়ার সমন্বিত পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (সিটিবিটি) অনুমোদন বাতিল করে বিলটি পাস করা হয়।

রাশিয়া জানায়, ওয়াশিংটন না করা পর্যন্ত তারা পারমাণবিক পরীক্ষা পুনরায় শুরু করবে না। তবে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রাশিয়া এ ধরনের একটি পরীক্ষার দিকেই আগাচ্ছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার পক্ষ থেকে যুদ্ধের মাত্রা বাড়ানোর ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।

সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়া পরমাণু পরীক্ষা করেনি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে মাত্র কয়েকটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করেছে।

আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ফ্রান্স ১৯৯৬ সালে, ভারত ও পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে ও উত্তর কোরিয়া ২০১৭ সালে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯০ সালে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করেছিল। ১৯৯৬ সালে রাশিয়া ব্যাপক পারমাণবিক-পরীক্ষা নিষিদ্ধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৬ সালে চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেছিল কিন্তু এখনো এটি অনুমোদন করেনি।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে রাশিয়ার পারমাণবিক হামলা চালানোর নির্দেশদাতা কে হবেন? রাশিয়ার ক্ষেত্রে মূলত পারমাণবিক অস্ত্রসংক্রান্ত সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তগ্রহীতা পুতিন নিজেই। তথাকথিত নিউক্লিয়ার ব্রিফকেস বা চেগেট সব সময় প্রেসিডেন্টের কাছেই থাকে। এছাড়া রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রে বেলুসভ ও চিফ অব জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভের কাছেও এ ধরনের ব্রিফকেস থাকতে পারে। বর্তমানে এ ধরনের ব্রিফকেসকে মূলত যোগাযোগের যন্ত্র বলা হয়ে থাকে। এ যন্ত্রের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও রকেটবাহিনী হয়ে গোপন ‘কাজবেক’ নামের বৈদ্যুতিক কমান্ড ও কন্ট্রোল নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কাজবেক কাভজাক নামের আরেকটি সিস্টেমকেও সমর্থন করে। প্রেসিডেন্টের কাছে থাকা ব্রিফকেসে কয়েক ধরনের বোতাম থাকে। কমান্ড সেকশনে থাকে দুটো বোতাম। এর মধ্যে একটি সাদা বোতাম বা চালু বোতাম ও আরেকটি লাল বা বাতিল বোতাম। বিশেষ একটি ফ্ল্যাশকার্ড ব্যবহার করে ব্রিফকেস চালু করা হয়।

রাশিয়া যদি মনে করে তারা কৌশলগত পারমাণবিক আক্রমণের শিকার হয়েছে, তবে প্রেসিডেন্ট ব্রিফকেস ব্যবহার করে সরাসরি আক্রমণের জন্য কমান্ড দিতে পারেন। এছাড়া তিনি পাল্টা হামলার জন্যও পারমাণবিক হামলার আদেশ দিতে পারে। এসব নির্দেশ পেলে বিভিন্ন যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে রকেট ফোর্স বিভাগকে হামলার জন্য প্রস্তুত করা যায়।

পারমাণবিক হামলা নিশ্চিত হলে পুতিন তথাকথিত ‘ডেড হ্যান্ড’ বা ‘পেরিমিটার’ হামলার নির্দেশও দিতে পারেন। এতে কম্পিউটার ব্যবস্থার মাধ্যমে রাশিয়ার পুরো অস্ত্র ধ্বংস করে ফেলা যাবে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে অবশ্য তাদের পুরো সিস্টেম সম্পর্কে কোনো তথ্য সামনে আনা হয়নি। এছাড়া সোভিয়েত যুগের পর থেকে তাদের সিস্টেম হালনাগাদ করা হয়নি। তাই তাদের পারমাণকি অস্ত্র ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থার বিষয়টি স্পষ্ট নয়।